আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে চান? - বিস্তারিত
ঢাকা আজঃ মঙ্গলবার, ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ ইং, ১১ই রবিউস-সানি, ১৪৪৬ হিজরী
সর্বশেষঃ

বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার স্বীকৃতি হতে পারে “স্মার্ট সোসাইটির” অন্যতম নিয়ামক

মোঃ বিল্লাল হোসেনঃ সমাজকর্ম ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করে নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী ও সামজিক ভুমিকা পালনে সক্ষম করে তোলে।
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যায়, “সমাজকর্ম হচ্ছে একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান যা মানুষকে মনোসামাজিক ভূমিকা পালনে একটি কার্যকর পর্যায়ে উপনীত হতে সাহায্য করে এবং সকল মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থবহ সামজিক পরিবর্তন আনয়নে সাহায্য করে থাকে।”
পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির প্রত্যক্ষ সুপারিশের মাধ্যমে ষাটের দশকে অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ঘটে। সমাজকর্ম হচ্ছে বিশেষায়িত পেশা।সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও মানুষের মধ্যকার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে । সমাজের সনাতনী চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োগ করে মানুষের চিন্তাভাবনাতে পরিবর্তন আনে সমাজকর্ম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সঠিক পরিচর্যা ও ভিত্তি গঠিত হয় সমাজকর্মীর মাধ্যমে। সমাজের বিশেষ লক্ষ্য পূরণ ও চিহ্নিত সমস্যা সমাধান করে একটি আদর্শ সমাজ বা সম্প্রদায় গঠন করাই হচ্ছে সমাজকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য।
একটি দেশের যথাযথ উন্নতির লক্ষণ দৃশ্যমান হয় স্থানীয় সমাজের উন্নয়নের মাধ্যমে। সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষার মান উন্নয়ন, মানবিক সম্পর্ক ত্বরান্বিতকরণ, মানবাধিকার চাহিদা পূরণ প্রভৃতি বিষয় দেশের স্থায়ী কাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দেশের আলাদা দৃষ্টান্ত তৈরি করে। উন্নত বিশ্বে এ কাজগুলো সম্পাদন করে একজন পেশাদার সমাজকর্মী। যার জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক সমস্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যে, দেশগুলোর অপরাধ প্রতিনিয়ত কমছে। এতে ওই দেশগুলোর পুনর্বাসন কেন্দ্র, অপরাধ নির্মূল কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ওই দেশগুলোর এ অবস্থানে নিয়ে আসার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্মীরা।
আমাদের দেশের আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজগুলোতে পড়ানো হচ্ছে সমাজকর্ম বিষয়টি। আমাদের দেশে পেশাদার সমাজকর্মীদের স্বীকৃতিহীনতার কারণে সমাজকর্ম পূর্ণমাত্রা পাচ্ছে না। একজন দক্ষ সমাজকর্মী সমাজের বিশেষ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও কাজ করে। তাছাড়া একজন বৈজ্ঞানিক গবেষণা নির্ভর সমাজকর্মী সমাজের প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নিয়েও কাজ করতে পারবে। এতে আমাদের মানুষের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার মান পরিশীলিত হবে। তাছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময় আসন্ন। ইতোমধ্যে সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে বলেছে সবাইকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে পেশাদার সমাজকর্মীরা।
কিন্তু আমাদের দেশে সমাজকর্মের প্রচলনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। পেশার মানদন্ড ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশে সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদার ক্ষেত্রে সমাজকর্মের নিজস্ব জ্ঞান ভান্ডার রয়েছে। সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে কোন লোক নিজেকে পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সমাজকর্মের যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বাংলাদেশে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম হিসেবে সমাজকর্মে স্বীকৃত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়িত সমাজসেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যাবলী মোকাবেলা করার জন্য সমাজকর্মের কৌশল, শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার জনকল্যাণমুখিতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজও নির্ধারিত হয়নি সমাজকর্মের পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড। সমাজকর্মের কার্যকর পেশাগত সংগঠন না থাকায় পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড গড়ে উঠেনি। পেশাগত সংগঠন যে কোন পেশার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে সমাজকর্মে পেশায় নিয়োজিতদের অদ্যাবধি কোন পেশাগত সংগঠন গড়ে উঠেনি।
তবে বিভিন্ন সময়ে পেশাগত সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। যেমন ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার মান উন্নয়ন ও সমাজকর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ‘‘বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি’’ গঠন করা হয়। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে “বাংলাদেশ সমাজকর্ম শিক্ষক সমিতি” নামে একটি পেশাগত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখন এর কার্যক্রম নেই। বাংলাদেশে সমাজকর্মের জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারে কাউন্সিল অন সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (CSWE) এর আদলে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (BCSWE) গঠন করা হয়েছে। BCSWE বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলনের মানোন্নয়ন ও পেশাগত স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে NASW, IASSW এবং APASWE এর মতো আন্তর্জাতিক পেশাগত সংগঠনসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত কর্মশালা ও জার্নাল প্রকাশ করছে, যা বাংলাদেশে সমাজকর্মের জ্ঞান বিকাশে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকর পেশাগত সংগঠনের অভাবে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পৃথক পেশার মর্যাদা অর্জনে সক্ষম হয়নি। বাংলাদেশে সমাজকর্মকে পৃথক পেশা হিসেবে অনুশীলন লাইসেন্স দানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। সহজভাবে বলা যায় সমাজকর্মকে সামাজিকভাবে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কৌশল বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পেশাদার ব্যক্তিদের মতো নিবন্ধনের মাধ্যমে সমাজকর্মীদের পৃথক পেশাদার ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। উক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে সব মানদন্ড ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে কোন বিশেষ বৃত্তিকে পেশার মর্যাদা দেয়া হয়, তার সবগুলো বাংলাদেশে সমাজকর্মের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়নি। তবে পেশার সার্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কটি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে সমাজকর্ম স্বতন্ত্র পেশার মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। তাই উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় আমাদের দেশেও সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া গ্রহণ করা অতি জরুরি। এছাড়া প্রতিটি সমাজকর্মীকে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে একজন সমাজকর্মী ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডাক্তার প্রকৌশলী, শিক্ষকের ন্যায় সমাজের গঠনগত পরিবর্তন আনয়নে কাজ করতে পারে।
১৯৭১ সালে পরাধীনতার গ্লানি মুছে একখণ্ড স্বাধীন ভূখণ্ড ও লাল সবুজ পতাকার মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ জন্ম লাভ কর উন্নয়নের পথে রয়েছে নানান বাঁধা। যা থেকে উত্তোরনে ও উন্নয়নে পেশাগত সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলন হতে পারে অন্যতম সহায়ক শক্তি।
বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যা যেমন- আত্মহত্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের সমস্যা, প্রবীণদের নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ প্রবণতাসহ ইত্যাদি। এসব আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা খুবই কার্যকরী।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। সমাজকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে সরকারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে দেশের পাঁচটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের প্রায় ১৫০০টি কলেজে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু রয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও সমাজকর্ম ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে চালু আছে। বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সম্ভাবনার সাথে সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠনের স্বক্রিয় তৎপরতা ও পেশাগত স্বীকৃতির বিষয়টি বিশেষভাবে জড়িত। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও তৎপরতার অদূর ভবিষ্যতে সমাজকর্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলে এদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
বর্তমান বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এক আধুনিক বিশ্ব। সমাজ ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি এনেছে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য চারটি ভিত্তির মধ্যে “স্মার্ট সোসাইটি” ধারণাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজকে স্মার্ট সমাজ হিসেবে গঠন করতে হলে অবশ্যই সেই সমাজের সামাজিক সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যাগুলো বেড়ে চলেছে। সমাজে বিদ্যমান এসকল সমস্যার সমাধান না করে “স্মার্ট সোসাইটির” স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তবে এ সকল সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন পেশাদার সমাজকর্মী। একজন দক্ষ সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে হলে প্রথমত প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। আর সমাজকর্ম হলো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রায়োগিক বিষয়। এছাড়াও এটি আন্তর্জাতিক তথা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সমাদৃত বিষয়। সমাজকর্ম হল অনুশীলন ভিত্তিক ও পদ্ধতি নির্ভর মানবীয় সম্পর্ক বিষয়ক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতা ভিত্তিক এক পেশাদার সেবাকর্ম। এটি ব্যক্তিগত, দলীয় ও সমষ্টিগত পর্যায়ে নানাবিধ মনো-সামাজিক সমস্যা দূর করে সমাজের কাঙ্খিত, ইতিবাচক ও গঠনমূলক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজ ও সমাজের মানুষের চিত্র বদলে দেয় এবং প্রত্যেককে তার অবস্থান অনুযায়ী সামাজিক ভূমিকা পালনের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে সহায়তা করে।
প্রতিবছর মার্চ মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম দিবস পালিত হয়। সে অনুযায়ী প্রতি বছরের ন্যায় বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে এবছর বাংলাদেশও “Shared Future for Transformative Change” শ্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস পালিত হতে যাচ্ছে ১৯ই মার্চ। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর সরকারি, বেসরকারি পর্যায় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। তবে আমাদের দেশে সমাজকর্ম বিষয় চালুর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি মেলেনি। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে “স্মার্ট সোসাইটি”গঠনে উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও সমাজকর্ম কে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করি।
এছাড়াও প্রতিটি সমাজকর্মীকে সরকারিভাবে নিবন্ধিত হওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যার দরুন একজন সমাজকর্মী ব্যক্তিগত উদ্যোগে ডাক্তার, প্রকৌশলী ও শিক্ষকের ন্যায় সমাজের গঠনগত পরিবর্তন করে নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা পালন করতে পারে। ঠিক তখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে চারটি স্তম্ভ তার মধ্যে অন্যতম “স্মার্ট সোসাইটি” ধারণাটি পূর্ণতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমাদের দেশের সামাজিক কাঠামো ব্যবস্থাপনায় এক জন সমাজকর্মীর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এক জন সমাজকর্মী তার অর্জিত প্রায়োগিক দক্ষতা দলমত নির্বিশেষে সমাজ, প্রশাসনে যথার্থভাবে প্রয়োগ করতে পারেন। সমাজে উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি আনয়নে কাজ করেন পেশাদার সমাজকর্মীরা। বিশেষ করে শিল্প ক্ষেত্রে অসন্তোষ দূর করার জন্য শিল্প সমাজকর্মী, চিকিৎসাক্ষেত্রে চিকিৎসা সমাজকর্মী, সাইক্রিয়াটিক ও ক্লিনিক্যাল সমাজকর্মী, প্রবিণদের জন্য প্রবিণ সমাজকর্মী এবং বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যালয় সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যদিও চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু সংখক হাসপাতালে চিকিৎসা অপেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তাও আবার তাদেরকে দিচ্ছেননা পেশাগত স্বীকৃতি। শিল্পায়নের যুগে বাংলাদেশে বর্তেমানে শিল্প কারখানায় মালিক-শ্রমিক দ্বন্ধ ও অসন্তোষ দিন দিন বেড়েই চলছে এক্ষেত্রে সমাজকর্মের অন্যতম শাখা শিল্প সমাজকর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করতে পারে।
শিল্পক্ষেত্রে পরামর্শ, উপদেশ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রশাসনকে সহায়তাসহ শ্রমিক জোট তৈরি করার ক্ষেত্রে শিল্প সমাজকর্মের গুরুত্ব তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিককল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিল্প সমাজকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করেন। শিল্প সমাজকর্মের ক্ষেত্র ক্যারিয়ার ও শিল্প সংক্রান্ত কাউন্সেলিং পারিবারিক কাউন্সেলিং আবেগীয় সমস্যা সংক্রান্ত কাউন্সেলিং অ্যালকোহল ও মাদক অপব্যবহার সংক্রান্ত কাউন্সেলিং ঋণ কাউন্সেলিং রিটায়ারমেন্ট পরিকল্পনা শিল্প সমাজকর্মী প্রকৃতপক্ষে একজন পরিবর্তন প্রতিনিধি হিসেবে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিল্পকারখানার শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সমস্যা যেমন মাদকাসক্তি, হতাশা, হীনমন্যতা বোধ, বৈবাহিক এবং শিশু শ্রমিকদের অপব্যবহার ইত্যাদি সমস্যা মোকাবিলায় শিল্প সমাজকর্মীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও শিল্প ক্ষেত্রে শ্রমিদের স্বার্থ সংরক্ষণে ও দাবিদাওয়া পূরণে গড়ে ওঠা সংগঠন ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে শিল্পসমাজকর্মীরা শ্রমিক-মালিক দ্বন্ধ নিরসন ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
আমাদের দেশের স্কুল থেকে ঝরেপড়া শিশুর সংখ্যা নিচের দিকে নয়। প্রথম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি, নবম-দশম থেকে একাদশ শ্রেণি—এ সময়গুলোতেই বিভিন্ন আর্থিক, সামাজিক, মানসিক কারণসহ নানা কারণে শিশুদের পড়াশোনার পথ বন্ধ হয়ে যায় অথবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোন কারণে শিশুটি স্কুলে যাচ্ছে না, শিশুটির স্কুলে না যাওয়ার পেছনে কি কারণগুলো দায়ী, শিশুর শিক্ষার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ইত্যাদি সমস্যার কি সমাধান হতে পারে এসব নিয়ে কাজ করার মতো বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তি আমাদের দেশে নেই। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না বলেই আমাদের দেশের শিশুরা অন্য দেশের শিশুদের মতো গুণগত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে না। শিশুর শিক্ষা সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যার সমাধান এবং পরামর্শ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিদ্যালয় সমাজকর্মী যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
একজন বিদ্যালয় সমাজকর্মী শিশুদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের বুঝার চেষ্টা করে এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে যা বিদ্যালয় সমাজকর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। আজকাল অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু এবং তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের প্রত্যাশিত বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকে না, থাকলেও তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে তাদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং সুবিধা সৃষ্টিতে বিদ্যালয় সমাজকর্মী, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
আজ বাংলাদেশে কিশোরা অতি দ্রুত মাদকের স্পর্শে গিয়ে অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশে কিশোর গ্যাং নামে অপরাধে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এরা খুন, ধর্ষণসহ নানাবিধ অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলে কাউকে জেল হাজতে পাঠানো হচ্ছে আবার কাউকে কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে রাখা হচ্ছে। প্রচলিত আইনে বিচার করা যাচ্ছে না। বড়দের সাথে জেল হাজতে একসাথে রাখার কারণে তারা পরবর্তীতে পেশাদার অপরাধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তাই এসকল কিশোরদের অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার একমাত্র উত্তম পন্থা হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্মীর তত্তাবধানে রাখা। একজন পেশাদার সমাজকর্মীই পারে এসকল কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।
একটি সমাজের পরিপূর্ণ উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের সমন্বয় সাধন হয় পেশাদার সমাজকর্মীদের মাধ্যমে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে সমাজের সৃষ্ট বিভিন্ন মানবাধিকার ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যা সমাধান ও সংস্করণে পেশাদার সমাজকর্মীরা তাদের অর্জিত জ্ঞান, কলাকৌশল প্রয়োগের উপযুক্ত ক্ষেত্র পায়। পেশাদার সমাজকর্মীরা এসব সমস্যা সমাধান করার ফলে সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নও বৃদ্ধি পাবে।
সহকারী অ্যধাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম, বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা (শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিক, ইমেইল-sun.bhola.bd@gmail.com)

ফেসবুকে লাইক দিন