শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা
মোঃ হেলাল উদ্দিনঃ আজ জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী। আইনজীবী কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ও সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র প্রথিতযশা বাঙালি রাজনীতিবিদ ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলায় বাকেরগঞ্জের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাতুরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সর্বভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ফজলুল হক। সর্বভারতীয় রাজনীতির পাশাপাশি গ্রাম বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর আপোষহীন ন্যায়নীতি ও অসামান্য বাকপটুতার কারণে রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন শেরে বাংলা (বাংলার বাঘ) নামে। অবিভক্ত বাংলার অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদর্শিতার জন্য ছিলেন সুপরিচিতি।
প্রখর মেধাসম্পন্ন ছাত্র এ কে ফজলুল হকের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাড়ির পরিবেশে এবং বাড়িতেই তিনি আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষায় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। পরে তিনি ভর্তি হন বরিশাল জেলা স্কুলে এবং সেখান থেকে ১৮৯০ সালে এন্ট্রাস পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৮৯৪ সালে তিনি একই বছরে রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পরীক্ষা পাশ করেন, যা ছিল একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
ইংরাজি ভাষায় এমএ পাঠ শুরু করলেও পরে তিনি গণিতশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি নেন ১৮৯৬ সালে। কথিত আছে, তিনি ইংরাজি ভাষায় এম.এ. পড়তে গেলে তাঁর এক সহপাঠী তাঁকে বলেছিলেন মুসলমান শিক্ষার্থীরা অঙ্ক পড়তে ভয় পায়। সে কারণেই কি তিনি ইংরাজিতে এম.এ. পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ওই সহপাঠীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাত্র ছয় মাসের প্রস্তুতি নিয়ে অঙ্কে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন।
তিনি আইনেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এবং কলকাতার খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখার্জির অধীনে দুইবছর শিক্ষানবিশীর পর কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি বরিশাল আদালতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে ফজলুল হক সরকারি চাকরি নিলেন কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯১১ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আবার ফিরে গেলেন কলকাতা হাইকোর্টে আইনের পেশায়, যেখানে তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৪০ বছর আইন প্র্যাকটিস করেছেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর বাংলার জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়লে, ঢাকার চতুর্থ নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন তৈরির কথা ভেবে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহ্বান করেছিলেন। ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ফজলুল হক। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। সেই অর্থে শেরে বাংলা মুসলিম লীগের পথচলার শুরু থেকেই দলটির সঙ্গে ছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি। ওই একই সময়ে পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ফজলুল হকই ছিলেন একমাত্র বাঙালি যিনি দিল্লিতে ১৯১৮ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ শহরে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ফজলুল হক তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, তাই ‘লক্ষ্ণৌ চুক্তি’ নামে অভিহিত। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রাদেশিক পর্যায়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। ওই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
১৯২৪ সালে তিনি বাংলার শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৩৫ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম বাঙালি মুসলমান মেয়র নির্বাচিত হন। সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা দেখেছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদের ওপর জমিদার ও মহাজনদের নির্মম অত্যাচার। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তী জীবনে দরিদ্র নিপীড়িত কৃষক সমাজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে তিনি প্রবর্তন করেছিলেন ঋণ সালিশী বোর্ড, প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন।
ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৩০ এবং ১৯৩২ সালের মধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পরপর বেশ কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তদানীন্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের সভাপতিত্বে। ১৯৩০-৩১ সালের প্রথম বৈঠকে কংগ্রেসের যোগদান প্রত্যাখান করেছিলেন মি. গান্ধী। কিন্তু মুসলিম লীগ ওই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছিল। ফজলুল হক ঐ বৈঠকে বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করে স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অবিভক্ত বাংলা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবার পর ১৯৩৭ সালে সেখানে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ব্রিটিশ ভারতে প্রজা পার্টি নামে সামন্ততন্ত্র বিরোধী যে দল ছিল সেটিকে ফজলুল হক কৃষক-প্রজা পার্টি নামে রাজনৈতিক দলে রূপান্তর ঘটান এবং ঐ নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে তাঁর দল তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এ. কে ফজলুল হক হন অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪০ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রথম ‘পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব’ পেশ করেন। ঐ অধিবেশনে ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমের মুসলমান প্রধান অংশে ‘স্বায়ত্তশাসিত পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার দাবি সম্বলিত সেই প্রস্তাব গৃহীত ও পাশ হয়। তাঁর ঐ বক্তৃতায় মুগ্ধ হয় পাঞ্জাববাসীরা তাঁকে উপাধি দিয়েছিল শের-ই-বঙ্গাল অর্থাৎ বাংলার বাঘ। তখন থেকে তিনি শেরে-বাংলা নামে পরিচিত হয়ে উঠেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ফজলুল হক ঢাকায় চলে যান এবং ১৯৫২ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ‘যুক্তফ্রন্ট’ দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও কার্যকর হবার পর তিনি স্বারষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে করাচি থেকে ঢাকা চলে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পদে তিনি ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের এক অভ্যূত্থানের পর তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়।
শিক্ষা বিস্তারে শেরে বাংলা অনন্য অবদান রেখেছেন। ১৯৪০ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে তাঁর প্রচেষ্টায় মুন্সিগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁর নিজের গ্রামেও তিনি একটি কলেজ এবং পাশাপাশি মাদ্রাসা ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফজলুল হকের উদ্যেগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামিয়া কলেজ ও মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লেডি ব্র্যার্বোন কলেজ। এছাড়া তিনি মুসলমানদের শিক্ষিত করে তুলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছিলেন।
১৯৬২ সালের ২৭শে এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবনাবসান হয়। আজ তাঁর ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। (তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা এবং তাঁকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ/ মোঃ হেলাল উদ্দিন- শিক্ষক, লেখক ও গবেষক)।