পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ভোলার খবর ডেস্ক: পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলিম উম্মাহর নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সর্বকালীন মানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ-শেষনবী, শ্রেষ্ঠনবী মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স.) এর আগমন ও তিরোধানের এদিনটি সীমাহীন তাৎপর্যপূণ। ঈদ, মিলাদ আর নবী তিনটি শব্দ যোগে দিবসটির নামকরণ হয়েছে। তিনটি শব্দই আরবি ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে। ঈদ শব্দটির অর্থ আনন্দ বা খুশি, মিলাদ অর্থ জন্মদিন আর নবী শব্দটি ইসলামের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ পরিভাষাসমূহের অন্যতম যা বাংলাভাষাতেও নবী অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের উৎসব বা নবীর জন্মদিনের আনন্দ।
পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বিশ্বের ঈমানি প্রেরনার জয় ধ্বনী নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে রবিউল আওয়াল মাসে। কোন নেয়ামত ও রহমত লাভ করলেই আনন্দোৎসব করা যেরূপ মানুষের স্বভাবজাত কাজ তদ্রূপ আল্লাহ তাআলার নির্দেশও তাই। যেমন কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘(হে রাসূল!) বল : আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক।’ (সূরা ইউনুছ : ৫৮)
ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) মুসলমানদের জন্য এমন একটি আনন্দোৎসব, যার কোনো তুলনা হয় না। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর দুনিয়ায় আগমন উপলক্ষে মক্কায় তাঁর জন্মোৎসব পালন করার প্রথাটি পালন করেন রসূলুল্লাহ (সা.) এর মহান দাদা মহাত্মা আব্দুল মোত্তালেব।
দিবসটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য সর্বপ্রথম মহাত্মা আব্দুল মোত্তালেবই বুঝে ছিলেন। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সকল সীরাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের সুসংবাদে আব্দুল মোত্তালেব আবেগে আপ্লুত হয়ে মক্কায় আনন্দ প্রকাশে অনেক লোকের মধ্যে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী, খাওয়ার দাওয়াতের আয়োজন করেছিলেন।
হযরত মওলানা সৈয়দ মুফতী মোহাম্মদ আমীমুল এহসান মোজাদ্দেদী বরকতী (র.) এর বর্ণনা অনুযায়ী, বৃদ্ধ সর্দার আব্দুল মোত্তালেব পৌত্রের জন্মের সংবাদ শ্রবণ করে গৃহে আগমন করেন এবং নবজাতক শিশুকে খানা-ই-কাবায় নিয়ে যান ও দোয়া করেন। সপ্তম দিবসে আকীকা করে মোহাম্মদ (সা.) নাম রাখেন এবং সমগ্র কোরাইশদেরকে দাওয়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার এই সন্তান সমগ্র বিশ্বে প্রশংসার অধিকারী হবে’।
হযরত শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (র.) এ সম্পর্কে তার বিখ্যাত পুস্তক ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ’য় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ১২ রবিউল আউয়াল (সোমবার) রসূলুল্লাহ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন বলে প্রসিদ্ধ বর্ণনায় বলা হয়েছে। এদিন মক্কাবাসীরা রসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মস্থানের জিয়ারত করত।
মহানবী রসূলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহতাআলা সকল জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ নির্ধারণ করেছেন এবং তারই মহান জাতিসত্তার গুণাবলীর কারণে আসমান ও জমিন এবং সকল মখলুকাতকে আল্লাহ তা’আলা সাধারণ নিয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন।
সিরাতুন্নবী মহানবী হযরত রসূলুল্লাহ (সা.) কে আল্লাহ তাআলা সমগ্র জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন বলে স্বয়ং পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল লিল আলামীন।’
হযরত ইমাম বুখারী (রহ.) বর্ণনা করেন : ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার বংশের একজনকে স্বপ্নে তাকে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনার অবস্থা কি? সে জবাবে বলল, তোমাদেরকে ছেড়ে আসার পর আমার কল্যাণজনক কিছুই হয়নি, হ্যাঁ, এই আঙ্গুল (শাহাদাত অঙ্গুলি) দ্বারা পানি পাই। কারণ, এ আঙ্গুলের ইশারায় আমি দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলাম।’
এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ফাতহুল বারী এবং আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহ.) তাঁর রচিত ‘আইনী’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন : ইমাম সুহাইলী (রহ.) উল্লেখ করেন যে, হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, অত্যন্ত দুরবস্থার মাঝে পতিত রয়েছে। সে বলল, ‘তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি শান্তির মুখ দেখিনি। তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব লাঘব করা হয়।’ হযরত আব্বাস (রা.) বলেন : ‘তার এ আযাব লাঘবের কারণ হলো রাসূলে পাক (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশিতে মুক্তি দেয়। (ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ১১৮; আইনী, ২০/৯৫)
কবি শেখ সাদী (রহ.)-এর ভাষায় :
‘মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,
রূপের ছটায় দূর করলে আঁধার ছিল যত-
সকল গুণের সমাবেশে চরিত্রে মহান,
তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।’
আল্লামা কুসতুলানী মহানবী রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাস- এই মতের সমর্থনে লিখেছেন যে, তাঁর জন্মতারিখে মক্কাবসীরা নিয়মিত জন্মস্থান জিয়ারত করত। এটি ওফাতের পূর্বের ঘটনা হওয়াই স্বাভাবিক। অর্থাৎ তাঁর জীবদ্দশায় মক্কী জীবনে মুসলমানগণ মহানবীর জন্মস্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এরূপ করে থাকতো। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে যে, মক্কায় মহানবীর জন্ম হয় কোন স্থানে? এ সম্পর্কে হজরত থানভী (র.) তিনটি মতের কথা উল্লেখ করেছেন, শোয়াব, রাদম ও আসফান। উল্লেখিত ঘটনাসমুহ মীলাদোৎসবের এক বড় দলিল।
আজ থেকে ১৪৪৬ বছর আগে বিশ্বমানবতা যখন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত, জীবন ও জগতের প্রত্যেকটি ক্ষেত্র যখন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত ঠিক তখনই ত্রাতা হিসেবে আবির্ভাব হয়েছিল মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স.) এর। সামাজিক বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক শ্বৈরশাসন, অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনা এককথায় সার্বিক অধঃপতন যে জাতিকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম অভিধা ‘বর্বর’ আখ্যায় প্রসিদ্ধ করে তুলেছিল সেই তাদেরই মহানবী (স.) তাঁর আদর্শের সুষমা দিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আদর্শ জাতিতে পরিণত করেছিলেন। যাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহর এরশাদ করেছেন, আর যারা সর্ব প্রথম হিজরতকারী এবং আনসারদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য আর যারা তাদের আন্তরিকভাবে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সেসব লোকের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন এমন জান্নাত যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত। তারা চিরকাল সেখানে বসবাস করবে আর এটাই মহা সাফল্য। (সূরা আৎ-তাওবা : ১০০)
বস্তুত বর্বর আরবরা আদর্শিক অবক্ষয়ের পথ ধরে মানবিক গুণাবলি হারিয়ে মনুষ্য পরিচিতির ন্যূনতম যোগ্যতাটুকুও খুঁইয়ে বসেছিল। সেই বর্বর মানুষগুলোই আবার যখন হজরত মোহাম্মদ (স.) এর সংস্পর্শে এসে নিজেদের চরিত্রকে আদর্শিক মানদণ্ডে উন্নীত করেছে সামান্য সময়ের ব্যবধানে তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। মানব জীবন ও সমাজের এই যে অভাবনীয় ও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এটা সম্ভব হয়েছিল কেবল হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর মহোত্তম আদর্শের অনুশীলনের ফলে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, হে কিতাবধারীগণ! তোমাদের নিকট আমার রাসুল আগমন করেছেন! কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে, তিনি তার অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয়ে মার্জনা করেন। বস্তুত তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এসেছে এবং একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ আল-কোরআন। এর দ্বারা আল্লাহ যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদের শান্তির পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদের স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনয়ন করেন এবং তাদের সরল-সঠিক পথে পরিচালনা করেন। (সূরা আল-মায়িদাহ : ১৫-১৬)
ঈদে মিলাদুন্নবী এলে মহানবী (স.)-এর জীবনাদর্শ ভিত্তিক আলোচনা, সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে পালিত হয়। তাই সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন চিত্তে, উচ্চকণ্ঠে বলতেই হয়, নবীর জন্মদিনটি দেড় হাজার বছরের পুরোনো হলেও ঈদে মিলাদুন্নবী সীমাহীন তাৎপর্যপূর্ণ।
আজ আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে চরম অশান্ত। অশান্তির দাবানল জ্বলছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। কোমলমতি শিশুরা আজ প্রতিপালনের ধারায় পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধিকার বঞ্চিত। মানব সভ্যতার মূল ভরসা যুব সমাজ আজ দিশেহারা। সমাজ প্রবাহের উৎস বয়োবৃদ্ধরা চরম হতাশায় স্থবির। পরিবার-সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কর্মস্থল, রাজপথ-বসতবাড়ি, মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা কোথাও যেন জীবনের স্বস্তি নেই, নেই কোন নিরাপত্তা। প্রতারণা-ধোকাবাজি, প্রতিহিংসা-নিষ্ঠুরতা, মানব চরিত্রের অংশে পরিণত হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। মিথ্যা সত্যের স্থান দখল করে নিয়েছে। সত্য আজ মিথ্যার কাছে পরাজিত। সমাজ সেবার নামে অসহায় জনগোষ্ঠীকে শোষণ করা হচ্ছে।
আমাদের জীবনের বিরাজমান প্রেক্ষাপটে ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব অপরিসীম। মহানবীর জীবন আদর্শকে আলোচনার ধারায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। রাজপথের মিছিল আর স্লোগানে নবী প্রেমের কারিশমা প্রদর্শন করেও কোনো ফল পাওয়া যাবে না। নবীর আদর্শকে চলমান জীবনের বাস্তবতায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে। কেবল তখনই জীবন ও সমাজের সব অসঙ্গতি দূরীভূত হয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। মহান আল্লাহ যেমনটি এরশাদ করেছেন, বলুন, (হে নবী) যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তবে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের পাপরাশি মার্জনা করে দেবেন। আল্লাহ হলেন পরম ক্ষমাশীল-অসীম দয়ালু। (সুরা আল-ইমরান : ৩১)
বর্তমান সমস্যাসংকুল বিশ্বে যেখানে মানুষ মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যেখানে সন্ত্রাস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, দেশে দেশে হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ চলছে, নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে, যেখানে আন্তধর্মীয় সমপ্রীতি ও সৌহার্দ বিনষ্ট হচ্ছে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতপার্থক্য ও আচার-আচরণের বিভিন্নতা সহ্য করা হচ্ছে না, সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুপম আদর্শ ও সার্বজনীন শিক্ষা অনুসরণই বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সমপ্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) আমাদের সবার মনে সহনশীলতা, সংযম, হৃদ্যতা, সমপ্রীতি, পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা সৃষ্টিতে সহায়ক হোক, আমিন।
লেখক: মোঃ বিল্লাল হোসেন জুয়েল, সহকারী অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা ও গবেষক, সাংবাদিক। Email: sun.bhola.bd@gmail.com