আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে চান? - বিস্তারিত
ঢাকা আজঃ শুক্রবার, ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩রা মে, ২০২৪ ইং, ২৩শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরী
সর্বশেষঃ

২৫ সেপ্টেম্বর, আত্মমর্যাদার ঐতিহাসিক দিন

বিপ্লব মন্ডল (বিশেষ প্রতিনিধি): আজ ঐতিহাসিক ২৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৪ সালের আজকের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯ তম অধিবেশনে প্রথম বারের মত বাংলা ভাষায় ভাষন দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষনের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য পৃথিবীর সব দেশ আনুষ্ঠানিক ভাবে জানতে পারে বাংলা ভাষার কথা, জানতে পারে বাংলা ভাষাভাষী বাঙ্গালী জাতির জন্য আছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার নাম বাংলাদেশ।
এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশকে সদস্য হিসাবে গ্রহণ করে। ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ আনন্দ উল্লাস করে। সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে ২৫ সেপ্টেম্বর। অধিবেশনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ওই সময় জাতিসংঘে ৬ টি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার নিয়ম ছিল। ৬ টির মধ্যে বাংলা ভাষা ছিল না। আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাভাষী এই নেতার বক্তৃতা শুনে উপস্থিত সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানগণ মুগ্ধ হন।
ওই সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন ফারুক চৌধুরী। তার লেখা “স্মরণে বঙ্গবন্ধু ” গ্রন্থ থেকে জানা যায় বঙ্গবন্ধুর নিউইয়র্ক সফরের আগে তখনকার পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দীন আহমেদ একদিন বলেন,জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষন প্রণয়নে সে সময়ের তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর খুবই আগ্রহ দেখান। জনাব ঠাকুর এর আগে ‘ইত্তেফাকের’ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি মনে করতেন বাংলা ভাষায় তার খুব দখল আছে। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বাংলাতেই ভাষন দিবেন, এটি জানার পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বাংলায় ভাষনের একটি খসড়া লিখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। পরে জানা যায়, ঠাকুরের ওই ভাষন বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়নি।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় দেওয়া ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষনের ইংরেজি অনুবাদ করে পাঠ করেন ফারুক চৌধুরী।
অবশেষে এলো সে ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পিনপতন নীরবতার মধ্যে তার স্বভাব সুলভ সাবলীল ভাষায় দৃপ্ত কন্ঠে বলেন, ” আজ এই মহিমান্বিত সমাবেশে দাড়াইয়া আপনাদের সঙ্গে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির অংশীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মানিয়ন্ত্রন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পূর্নতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীন ভাবে বাচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাচার জন্য বাঙালি জনগন শতাব্দীর পর শতাব্দী সংগ্রাম করিয়াছেন। তাহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদদের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন।”
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন,” আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে।এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংস, ভীতি এবং আনবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকার ও দারিদ্র্যের কষাগাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুল ভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তোলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতি আনবিক যুদ্ধের হুমকী মুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রুপায়ন সম্ভব করিয়া তুলিবে এবং যে কারিগরি বিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদিরত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তোলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে। যে অর্থনৈতিক উত্তেজনা সম্প্রতি সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়াছে তাহা একটি ন্যায় সংগত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া জরুরী ভাবে মোকাবিলা করিতে হইবে।”
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অবস্থান ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমানের জন্য উপমহাদেশে আপোষ মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করেছি।”
পরিশেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, “জনাব সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস রেখে আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতেছি। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি কিন্তু মরিব না। টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগনের চরম শক্তি আমাদের স্বনির্ভরতা।”
ভাষন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত বিশ্ব নেতারা নিজ নিজ আসন থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন ও আলিঙ্গন করেন। বাংলা ভাষা আসলে সেদিন থেকেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মর্যাদা লাভ করে।
ওই সফরে বঙ্গবন্ধু ন্যায় সংগত কথা বলতে কাউকে পরোয়া করেননি। সে সময়ের কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন। হেনরী কিসিঞ্জারের এই বক্তব্যের জবাব খোদ আমেরিকাতে বসেই দিয়েছিলেন।
ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “কেউ কেউ বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দুশো বছর ধরে বাংলাদেশের সম্পদ লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদ দিয়েই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, করাচী,ইসলামাবাদের। আজো আমাদের অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাড়িয়েছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসাবে প্রথম বারের মত বাংলায় ভাষন দিয়ে বঙ্গবন্ধু যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। সেই ভাষন দেওয়ার ৪৯ তম বার্ষিকীতে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাঙ্গালী জাতি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।

ফেসবুকে লাইক দিন