আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে চান? - বিস্তারিত
  • শনিবার, ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং, ১৪ই জমাদিউস-সানি, ১৪৪৭ হিজরী
সর্বশেষঃ

আমার দুরন্ত শৈশব; পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙতো আমাদের

মোঃ মহিউদ্দিন: ভোরের আলো তখনো দিগন্ত ছুঁয়ে ওঠে না, ঠিক সেই সময়টাতেই পাখির কলকাকলিতে আমাদের ঘুম ভাঙতো। শালিকের টুকটুক ডাক, চড়ুইয়ের কিচিরমিচির, দোয়েলের অপূর্ব সুর আর ঘুঘুর গভীর মোলায়েম ডাক মিলে যে সিম্ফনি তৈরি হতো—সেটিই ছিল আমাদের শৈশবের আলোর ঘণ্টা। চোখ মেললেই দেখতাম জানালার ওপারে বাগানভরা অসংখ্য পাখি, যেন তারা প্রতিদিনের মতোই আমাদের ডাকতে এসেছে—“ওঠো, নতুন দিন শুরু হয়েছে।”
আমাদের বাড়ির রাস্তার ঠিক উত্তর দিকে ছিল ‘লুৎফর রহমান সিকদার বাড়ি’। বিশাল আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই বাড়ি দুই ভাগে বিভক্ত—এক পাশে বসবাস করতেন লুৎফর রহমান সিকদার, আর অপর পাশে বসবাস করতেন ডাক্তার আব্দুল মালেক ও তাঁর পরিবার। সিকদার সাহেবের বাড়িটি তুলনামূলকভাবে খানিকটা অরক্ষিত হলেও, ডাক্তার আব্দুল মালেকের বাড়িটি ছিল নিখুঁত সুরক্ষায় মোড়া, শৃঙ্খলিত আর অত্যন্ত পরিপাটি। কাচারি ঘরটি ছিল বাড়ির গৌরব, আর সেখানে বসে লুৎফর রহমান শিকদার সাহেব সেগুন কাঠের শিল্পসম্মত চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে টান দিতেন তাঁর বিখ্যাত প্যাচের হুক্কা। প্রতি টানে ধোঁয়া উঠতো ছাদ পর্যন্ত, আর পুরো ঘর ভরে যেত তামাকের সেই চেনা বোটকা গন্ধে। আমরা ছোটরা দূর থেকে তাকিয়ে থাকতাম। সামান্য সাহস সঞ্চয় করে কখনো তাঁর কাছ থেকেই নিয়ে নিতাম হুক্কার মাথা। কৌতূহলের টানে যখন টান দিতাম—তখন কেমন যেন এক অদ্ভুত, আরেকটু রহস্যময় স্বাদ লাগতো। দ্বিতীয় টান যে আর নেয়া যেত না, সেটা অবশ্য পরের মুহূর্তেই বুঝে যেতাম! অন্যদিকে ডাক্তার আব্দুল মালেক—একজন লম্বা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সুপুরুষ; সাদা জামা, সাদা লুঙ্গি—চরিত্রে-চলায়-চলনে অদ্ভুত পরিছন্নতা। তাঁর মধ্যেই চিকিৎসকের এক বিশেষ মহিমা দেখতাম। নাছির মাঝি সড়কের পাশে নিজের ফার্মেসিতে তিনি বসতেন ধীরস্থির ভঙ্গিতে, রোগী দেখতেন মনযোগ দিয়ে। তিনি ছিলেন আমার দাদা-সম সম্পর্কের, আর আমাদের ছোটখাটো অসুখে-জ্বরে তিনিই ছিলেন প্রথম ভরসা। তাঁর স্নিগ্ধ ডাক্তারি দেখে আমার ছোটবেলাতেই মনে হয়েছিল—“বড় হয়ে আমিও ডাক্তার হবো।”
হয়তো সেই শৈশবের স্বপ্নই আজ আমাকে চিকিৎসকের পথ দেখিয়েছে। ডাক্তারের বাড়ির চারপাশে ছিল দুর্ভেদ্য মেহেন্দি কাঁটার বেষ্টনী—এতটাই ঘন আর কাঁটাময় যে ভেতরে ঢোকার সাহস কারো ছিল না। বাড়ির কাঠের দোতলাটি ছিল পরিপাটি, উঠোনে সারি সারি অচেনা-চেনা ফুলের সমারোহ। দেশি-বিদেশি ফুলের রঙিন বাগানটি ছিল আমার জীবনে প্রথম দেখা প্রকৃতির রাজ্য। মনে হতো বাড়িটি যেন ফুলের সুবাসে ভেসে থাকা কোনো ছোট রাজপ্রাসাদ। ডাক্তারের বড় ছেলে আবুল বাশার ও আমার বড় ভাই হারুন অর রশিদ ছিল সমবয়সী। দু’জনের বন্ধুত্বের সুবাদে আমরা প্রায় প্রতিদিন যেতাম সেই বাড়িতে। কখনো বাগানের ভেতর খেলতাম, কখনো উঠানের পাশের ঝাঁকড়া বাঁশঝাড়ে লুকোচুরি, কখনো আবার গাছপালা ঘেরা শীতল ছায়ার নিচে বসে গল্প করতাম। দুপুর হলে বাড়ি ফিরে খাবার সেরে আবারও ছুটে যেতাম—শৈশব আমাদের ডাকতো, আমরাও ছুটতাম নিরন্তর। গাছপালা এত বেশি ছিল যে সূর্যের আলো সরাসরি মাটিতে নামার সুযোগ পেত না। প্রকৃতির এই ছায়াঘেরা রাজ্যে বাস করতো অসংখ্য পাখি—শালিক, চড়ুই, দোয়েল, ঘুঘু, টিয়া, বক, বাবুই আর নাম না জানা আরও কত রঙিন ডানার অতিথি। ভোরে তাদের ডাকে ঘুম ভাঙত, বিকেলে তাদের মিষ্টি কিচিরমিচিরে মন ভরে যেত, আর রাতে তাদের মৃদুমন্দ ডাকে আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম। মনে হতো, আমাদের জীবন যেন প্রকৃতির বুকে রেখে লেখা এক অপূর্ব অধ্যায়। এই সব দৃশ্য—এই সব শব্দ—এই সব গন্ধ… আজও মনে হলেই বুকের ভেতর শৈশবের নিস্পাপ আনন্দ উথলে ওঠে। ডাক্তার আব্দুল মালেকের বাড়ি, লুৎফর রহমান সিকদারের কাচারি ঘর, মেহেন্দি বেষ্টনী, ফুলের বাগান, বাঁশঝাড় আর অসংখ্য পাখির সমাবেশ—সব মিলেই আমাদের শৈশব ছিল এক অপার শান্তির অমর ঠিকানা। সেই বাড়ি, সেই মানুষগুলো, সেই দিনগুলো— আজও মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দিতে পারবো। আমাদের শৈশব ছিল প্রকৃতির কোলে লেখা এক মনোহর কবিতা।

ফেসবুকে লাইক দিন