গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ঝালকাঠির শীতলপাটি
মোঃ মাছুম বিল্লাহ কাঠালিয়া প্রতিনিধি: গরমের প্রশান্তির আরেক নাম শীতলপাটি। আদিকাল থেকেই গ্রামবাংলা ও বাঙালির জীবনযাত্রায় জড়িয়ে রয়েছে এ পাটি। একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়িতে অতিথি এলে তাকে বসতে দেওয়া হতো শীতলপাটিতে। আধুনিক যুগে এসি, ফ্যানসহ বাতাস শীতলীকরণে বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে শীতলপাটির উৎপাদন ও ব্যবহার কমে আসলেও এখনো অনেকেই আগ্রহভরে গরমে শীতলপাটিতে ঘুমান। শুষ্ক মৌসুমে শীতলপাটি বেশি গরম হয় না বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে শীতলপাটি। প্রতিটি বুননে আছে শীতলতা। শীতলপাটি বেশ ঠান্ডা হওয়ায় গ্রামে একে প্রাকৃতিক এসিও বলেন কেউ কেউ। শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত ঝালকাঠি। এ জেলার শীতলপাটির বিশেষ কদর থাকায় বহুকাল ধরে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। জেলার রাজাপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষরা শীতলপাটি বুননে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এখানকার চিকন বেতির শীতলপাটির চাহিদাও প্রচুর। এ অঞ্চলে অতিথিদের সামনে শীতলপাটি বিছিয়ে নিজেদের আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বর্তমানে ঝালকাঠি জেলায় প্রায় ৩০০ এর বেশি পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। রাজাপুর উপজেলার হাইলাকাঠি ও ডহরশংকর গ্রামে রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। এরা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করেন। পুরাতন ঐতিহ্যের কারু হাতে গড়া শীতলপাটির জন্য এ গ্রাম দুটিকে ‘শীতলপাটির’ গ্রামও বলা হয়। এ গ্রামের শতশত হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বিশাল নজরকাড়া শীতলপাটি তৈরির মোর্তা বা পাইত্র্যা বাগান। এখানে শীতলপাটি, নামাজের পাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনের পাটি তৈরি করা হয়। সবচেয়ে বেশি শীতলপাটি তৈরি হয় হাইলাকাঠি গ্রামে।
জানা গেছে, শীতলপাটি বুননে রাজাপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে মোর্তা বা পাইত্র্যা বাগান রয়েছে। কেউ পাটি বুনেন আবার কেউ কেউ পাটি বুননের জন্য মোর্তা চাষ করেন। মোর্তা বা পাইত্র্যা প্রাকৃতিকভাবে জন্মালেও নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। একবার একটি মোর্তা মূল লাগালে তা দীর্ঘদিন ধরে গোড়া থেকে গজাতে থাকে। এ গাছ প্রায় ৭-১০ ফুট লম্বা হয়। ৮০টি মোর্তা গাছ বিক্রি করা হয় ২০০/৪০০ টাকা। একটি পাটি তৈরি করতে সাধারণত ৩ থেকে ৪ দিন লাগে। তবে বয়স্ক একজন পাটিকর একাই পাটি বোনার কাজ করলে ৭ দিন সময় লাগে। একটি পরিবার মাসে কমপক্ষে ১০টি পাটি তৈরি করতে পারেন। আর এ থেকে পরিবারটির মাসিক আয় সর্বোচ্চ ৭/৮ হাজার টাকা। একটি ভালোমানের পাটির দাম বাজারে প্রায় ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা। মধ্যম মানের পাটির দাম ৬০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা।
স্থানীয়রা জানান, ঝালকাঠি জেলার ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি আনুমানিক ৩০০ বছর ধরে বংশ পরস্পরায় চলে আসছে। এক সময় ঝালকাঠি শহর এবং ঝালকাঠি জেলাধীন রাজাপুর উপজেলার বিশেষ কয়েকটি এলাকায় এ শিল্পের প্রসার ঘটে। ঝালকাঠি শহরের কাশারি পট্টিতে এক সময় ৮/১০টি শীতলপাটির দোকান ছিল। এখন মাত্র ৩টি দোকানে পাটি পাওয়া যায়। পাটিকররা এসব দোকানে পাইকারি মূল্যে পাটি বিক্রি করেন। এ ছাড়া অনেকে মাথায় ফেরি করে পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তারা আরও জানান, গত দুই বছর ধরে এসএমই ফাউন্ডেশন শীতলপাটি দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প পণ্য তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ঝালকাঠির পাটিকরদের আয় কিছুটা বেড়েছে। তারা এখন শীতলপাটি দিয়ে কলমদানি, টিস্যু বক্স, ট্রেসহ নানা ধরনের পণ্যও তৈরি করছেন। এ শিল্পের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য মতে, ঝালকাঠি থেকে বর্তমানে বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার শীতলপাটি সরবরাহ করা হচ্ছে।
হাইলাকাঠির বাসিন্দা পুতুল পাটিকর বলেন, বাপ দাদার আমল থেকে পাটি বুনার কাজ চলছে দেখে আমাদের বংশের নাম পাটিকর। ১০ বছর বয়স থেকে পাটি বুনি। এখন বিয়ে হইছে, স্বামীর বাড়ি এসেও পাটি বুনি। আমাদের তো আয়ের কোনো উপায় নেই। মোর্তা কিনতে হয়। মোর্তার কোনো ক্ষেত নাই। একটা পাটি তৈরি করতে ৫ দিন সময় লাগে। তারপর সেই পাটির দাম ৮০০ টাকা। পাটি ৫০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত আছে। এতে অনেক খরচ হয় কিন্তু আমাদের লাভ হয় না তেমন। সরকার যদি আমাদের ভিজিএফ কার্ড করে দিত তাহলে সুবিধা হত।
পাটি শিল্পী তপন পাটিকর বলেন, শিতলপাটি তৈরির কাজ ১২ মাসই কমবেশি থাকে। তবে গরমের মৌসুমে সবচাইতে বেচা বিক্রি বেশি হয়। সেই সময় কাজের চাপ খুব বেশি থাকে। বর্তমানে শীতলপাটির বাজার মোটামুটি ভালো। তবে পাটি তৈরি করতে একজন লোকের ২ থেকে ৩ দিন সময় লেগে যায়। সে তুলনায় মজুরি কম। প্রকারভেদে প্রতিটি শীতলপাটির দাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে।
রাজাপুরের আশার আলো শীতল পাটি উন্নয়ন প্রকল্প সমিতির সভাপতি অবিনাশ চন্দ্র পাটিকর বলেন, সিডরের সময় সেনাবাহিনী ৪ লাখ টাকা দিয়ে দুটা ঘর তৈরি করে দিছে। গরমের সময় সবাই সেখানে বসে পাটি তৈরি করে। বর্তমানে ঘর দুটি নাজুক আর বেহাল দশা। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পরে যেতে পারে।
তিনি বলেন, সরকার যদি ঘর দুটা নতুন করে নির্মাণ করে দেয় তাহলে আমরা ওখানে কাজ করতে পারতাম। সমিতির সামনের মাঠে বর্ষাকালে বেতি শুকানো যায় না। পানিতে বেতি নষ্ট হয়ে যায়। সরকারিভাবে বালু দিয়ে মাঠ ভরাট করে দিলে বেতি শুকানো যেত। আমরা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাই না। যদি পেতাম তাহলে খেয়ে পরে বাঁচতে পারতাম।
রাজাপুরের হাইলাকাঠি গ্রামের সুদেব পাটিকর বলেন, গরমের দিনে শীতলপাটির কদর বেশি থাকে। দূরদূরান্ত থেকে খরিদদার এসে আমাদের হাতে বোনা শীতলপাটি নিয়ে যাচ্ছে। তবে আর্থিক অভাবের কারণে চাহিদা মতো কাজ করতে পারছি না আমরা।
শীতলপাটি ব্যবসায়ী মনীন্দ্র পাটিকর বলেন, সারা দেশে ঝালকাঠির পাটির বেশ চাহিদা রয়েছে। বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে এখানকার শীতলপাটি। পাটিশিল্পী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিনাস পাটিকর বলেন, চট্টগ্রাম দিয়ে এখানকার শীতলপাটি বিদেশে পাঠানো হয়। বিদেশে এ পাটির ভালো কদর রয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সংস্থা (বিসিক) ঝালকাঠির উপমহাব্যবস্থাপক ফয়জুর রহমান বলেন, শীতলপাটি শিল্পের জন্য ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমই ফাউন্ডেশন) সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মোরশেদ আলম বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ শীতলপাটির বিপণন, বহুমুখীকরণ, নকশা উন্নয়ন এবং অর্থায়নে সহযোগিতার লক্ষ্যে কাজ করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
জেলার সুপরিচিত এ ব্র্যান্ড পণ্যের বিষয়ে নজর রাখার কথা জানিয়ে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম কালবেলাকে বলেন, জেলার শীতলপাটির প্রসার এবং এর সঙ্গে যুক্তদের উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে জেলা প্রশাসন।