“দ্বীপের নিঃশ্বাস: অবহেলার খাঁচায় বন্দি ভোলার বিশ লাখ মানুষের দীর্ঘশ্বাস”

মোঃ মহিউদ্দিন: ভোলা—বাংলাদেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ দ্বীপ জেলা। প্রকৃতি এখানে তার সৌন্দর্যের সবটুকু ঢেলে দিয়েছে; অথচ এ জেলার মানুষের জীবনে তার ছিটেফোঁটা সুবিধাও পৌঁছায়নি। যেন বিশ লক্ষ মানুষের স্বপ্ন, সম্ভাবনা আর প্রাপ্য অধিকারকে এক অদৃশ্য খাঁচায় আটকে রেখেছে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা। ভোলার বিস্তীর্ণ মেঘনার বুক চিরে বয়ে চলেছে নিরব নদী, কিন্তু মানুষের বুকের ভেতর জেগে থাকে স্রোতের মতো তীব্র দীর্ঘশ্বাস।
এই জেলার মাটি শুধু উর্বরই নয়—প্রতিটি মৌসুমে ধানের সোনালি ঢেউ নেচে ওঠে। বাড়ির আঙিনা থেকে নদীর কিনারা—সুপারি, নারকেল, কলা, শাকসবজি; এমন কোনো ফসল নেই যে এখানে জন্মায় না। খাল-বিল-নদীঘেরা ভোলা মাছের ভাণ্ডার। বিশেষত ইলিশের প্রাচুর্যে মেঘনার উপকূল যেন এক অনন্য আশীর্বাদ। প্রকৃতির এই উদারতা যে কোনো অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারত—যদি সঠিক পরিকল্পনা, অবকাঠামো আর রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি এখানে থাকত। তবু দীর্ঘ বছর ধরে ভোলা যেন শুধু এক বিস্মৃত প্রান্তিক জনপদের নাম। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা—সবকিছুই এখানে পৌঁছায় বহুদূর পেছনে পড়ে থাকা সময়ের স্লোগানের মতো। নদীভাঙনে প্রতিবছর হাজার মানুষ ঘরবাড়ি হারালেও পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা থাকে না; যোগাযোগব্যবস্থা থেমে থাকে অর্ধেক পথে; আর চিকিৎসা মেলে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক সত্য—ভোলার বুকে লুকিয়ে থাকা প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার। যে গ্যাস দেশের জ্বালানি ঘাটতি সহজেই পূরণ করতে পারে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারে, শিল্পায়নের দরজা খুলে দিতে পারে—সেই সম্ভাবনা আজও বন্দি অরক্ষিত, অকর্মণ্য অন্ধকারে। ভোলার মানুষ দেখছে—তাদের পায়ের নিচের সম্পদ দিয়ে সমৃদ্ধ হতে পারে পুরো জাতি, অথচ তারা নিজেরাই বঞ্চিত থাকে মৌলিক চাহিদা থেকেও। যেন সম্পদের ওপর তাদের অধিকার নেই, কেবল অপেক্ষা আর হতাশাই তাদের নিয়তি। ভোলার মানুষ আজও ফেরিঘাটে দাঁড়িয়ে সময় হারায়, হাসপাতালে পৌঁছে হারায় আরও সময়, আর ভালো শিক্ষার স্বপ্ন হারিয়ে যায় কর্মসংস্থানের অভাবে দূর দুরান্তে। তবু এখানকার মানুষের মন বড়, স্বপ্ন আরও বড়। প্রকৃতি যেমন অকৃপণ—তেমনি ভোলার মানুষের ভালোবাসা, সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার শক্তিও অসীম।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—কতদিন? কতদিন ভোলা থাকবে অবহেলার দ্বীপ? কতদিন প্রকৃতির আশীর্বাদ থাকা সত্ত্বেও জীবন কাটবে অভাবের অন্ধকারে? ভোলার বিশ লক্ষ মানুষ আজ তাদেরই জন্মভূমির মাঝে বন্দি। তারা চায় না বাড়তি কিছু; তারা চায় আলো, রাস্তা,সেতু, হাসপাতাল, কর্মসংস্থান—সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার। চায় তাদের সম্পদ, তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের সম্ভাবনা যেন আর অবহেলার গর্ভে হারিয়ে না যায়। অতএব সময় এসেছে ভোলাকে দেখা—এক ‘দূরবর্তী দ্বীপ’ নয়, বরং এক অমূল্য সম্ভাবনার ভাণ্ডার হিসেবে। সময় এসেছে ভোলার মানুষের শ্বাস নেওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। সময় এসেছে এই দ্বীপকে তার প্রকৃত মর্যাদা দেওয়ার। # লেখক: কবি, সাহিত্যিক, সিনিয়র লেকচারার
