মানবিকতার আলোকবর্তিকা: ভোলার প্রিয় জেলা প্রশাসক আজাদ জাহানের বিদায়বেলা–মোঃ মহিউদ্দিন

ভোলার খবর ডেস্ক: ভোলা জেলার আকাশে আজ যেন এক অজানা বিষাদের মেঘ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রাঙ্গণে কেমন যেন এক নিস্তব্ধতা—যেন প্রিয় এক আপনজনের প্রস্থান। বদলিজনিত কারণে বিদায় নিচ্ছেন ভোলার মানবিক জেলা প্রশাসক জনাব আজাদ জাহান। মাত্র চৌদ্দ মাসের সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি এমনভাবে ভোলার মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, যেন বহু বছরের আপনজন। আজ যখন তাঁর শেষ কর্মদিবসে সহকর্মী, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ী, কৃষক—সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এসে জড়ো হলেন তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানে, তখন দৃশ্যটি ছিল এক আবেগঘন মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি। অনেকের চোখে ছিল অশ্রু, মুখে অনিচ্ছুক হাসি—বিদায় জানাতে গিয়েও কেউ যেন বিদায় জানাতে পারছিল না।
ভোলার মানুষ যাকে বলত “আমাদের প্রশাসক” জনাব আজাদ জাহান ছিলেন শুধু একজন প্রশাসক নন; তিনি ছিলেন মানুষের বন্ধু, পরামর্শদাতা ও অভিভাবকসুলভ এক আশ্রয়স্থল। ভোলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের দরিদ্র-অসহায় মানুষ—সবাই জানত, জেলা প্রশাসকের দরজা তাদের জন্য সর্বদা খোলা। কোনো প্রহরী বা আনুষ্ঠানিকতার দেয়াল তাঁর মানবিকতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। একজন বৃদ্ধ মাছ বিক্রেতা বলেছিলেন, “স্যাররে কাছে গিয়া আমার কথা কইছি, উনি মন দিয়া শুনছে, কাগজে লিখছে, আর একটু পরেই অফিসে ফোন দিয়া ব্যবস্থা করছে।” এই ‘শুনে নেওয়া’ মনটাই তাঁকে আলাদা করেছে—যা আজকের দিনে প্রশাসনের আসল শক্তি হওয়া উচিত। দপ্তরের দেয়ালে মানবতার আলোকছটা তাঁর অফিসে ঢুকলেই বোঝা যেত, এটি কোনো ক্ষমতার আসন নয়, বরং সেবার মঞ্চ। ফাইলের স্তূপের পাশে হাস্যোজ্জ্বল মুখ, এক কাপ চা, আর আন্তরিক কথোপকথন—এই ছিল তাঁর প্রশাসনিক সংস্কৃতি। তিনি বিশ্বাস করতেন, “প্রশাসনের মূল কাজ হলো জনগণের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ওপর নয়, তাদের সঙ্গে থাকা।”ভোলার মানুষ আজও স্মরণ করে তাঁর রাতভর ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও ত্রাণ কার্যক্রম তদারকি, দুর্গত মানুষের কাঁধে হাত রেখে বলা সেই সান্ত্বনার কথা—“আপনাদের কষ্ট আমার কষ্ট।” মানবিকতার রোল মডেল জনাব আজাদ জাহানের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্ত ভাব ছিল—যা কেবল একজন সৎ, নিরহংকারী ও নৈতিক ব্যক্তির মাঝেই থাকে। তিনি প্রশাসনিক পদে থেকেও অহংকারহীনভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতেন। কেউ বলত, “স্যার যেন বন্ধুর মতো আচরণ করতেন,” আবার কেউ বলত, “উনি ছিলেন বাবা-সুলভ।” তাঁর নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজ করতেন একদম নতুন উদ্দীপনায়। অফিস ছিল প্রাণবন্ত, কর্মচঞ্চল ও জনগণের জন্য উন্মুক্ত। তাঁর এই প্রশাসনিক নীতি—‘মানুষই প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু’—ভোলার প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
চলে যাওয়া মানে শেষ নয়, আজ যখন তিনি ভোলার মানুষকে পেছনে রেখে চলে যাচ্ছেন, তখন চারপাশে শুধুই এক প্রশ্ন—“এমন একজন প্রশাসক কি আবার আসবেন?” সবার মনে একই সুর—“উনি যদি আর একটু সময় ভোলায় থাকতেন!” কিন্তু সত্যিই চলে যাওয়া মানেই শেষ নয়। আজাদ জাহান রেখে গেলেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত, রেখে গেলেন এক মানবিক প্রশাসনের স্বপ্ন, যেখানে ক্ষমতা নয়—ভালোবাসাই হবে সেতুবন্ধন। শেষ কথন; ভোলার মানুষ আজ এক নামেই আশ্রয় খুঁজে পায়—আজাদ জাহান। তিনি চলে যাচ্ছেন, কিন্তু রেখে যাচ্ছেন মানবিকতার এমন এক ইতিহাস, যা আগামী দিনের প্রশাসকদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। ভোলার বাতাসে, নদীর জলে, মানুষের ভালোবাসায় চিরদিন ভেসে থাকবে তাঁর নাম— “মানবিক প্রশাসক আজাদ জাহান”, যিনি দেখিয়েছেন—ক্ষমতা নয়, মানবতা-ই প্রশাসনের আসল শক্তি।
# লেখক: কবি/সাহিত্যিক/সিনিয়র লেকচারার
