চুলকানি ও তার প্রতিকার: ইউনানী চিকিৎসার প্রাকৃতিক ও কার্যকর ভূমিকা।

লেখকঃ হাকীম মোঃ রাজিউর রহমান
ডিইউএমএস-ঢাকা।
বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে যে সকল সাধারণ অথচ বিরক্তিকর চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, তার মধ্যে চুলকানি অন্যতম। এটি যদিও প্রাণঘাতী নয়, তবে দীর্ঘস্থায়ী হলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত করে তোলে। রাতের ঘুম নষ্ট করা থেকে শুরু করে সামাজিক অস্বস্তির কারণ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় এই রোগ। সুখবর হলো—এই সমস্যার প্রাকৃতিক ও কার্যকর প্রতিকার রয়েছে প্রাচীন ইউনানী চিকিৎসা ব্যবস্থায়, যা বর্তমানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
চুলকানি একটি সাধারণ সমস্যা হলেও অবহেলায় তা জটিল চর্মরোগে পরিণত হতে পারে। ইউনানী চিকিৎসা প্রাকৃতিক, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন এবং দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এটি বর্তমানে অধিক গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ ও জীবনাচারে পরিবর্তনের মাধ্যমে চুলকানির প্রকোপ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। তাই আমাদের উচিত এই প্রাচীন ও প্রাকৃতিক চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখা এবং প্রয়োজনমতো ইউনানী চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।
চুলকানি: কারণ ও লক্ষণ:
চুলকানি (ইংরেজিতে Itching ev Pruritus) একটি সাধারণ ত্বকের সমস্যা, যা শরীরের নির্দিষ্ট স্থান বা পুরো শরীরে হতে পারে। এটি অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি করে, যা মানুষকে ঘন ঘন চুলকাতে বাধ্য করে। এর প্রধান কারণসমূহ হলো—
ত্বকের অ্যালার্জি ও সংক্রমণ, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ, স্ক্যাবিস (ধুরা রোগ), অতিরিক্ত ঘাম বা অপরিচ্ছন্নতা, ত্বকের শুষ্কতা, লিভার বা কিডনির জটিলতা, পোকামাকড়ের কামড় বা খাদ্য অ্যালার্জি
চুলকানি দীর্ঘস্থায়ী হলে ত্বকে ফুসকুড়ি, জ্বালা, প্রদাহ ও ক্ষরণের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাই এটি অবহেলা না করে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
প্রতিকার: জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের মাধ্যমে:
চুলকানির চিকিৎসার আগে এর সঠিক কারণ নির্ণয় জরুরি। প্রতিকারমূলক কিছু সাধারণ পদক্ষেপ নিচে দেওয়া হলো—
১। নিয়মিত গোসল ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
২। ঢিলা ও সুতির কাপড় পরিধান করা
৩। ঘাম ও ধুলাবালির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা
৪। ঝাল, ভাজা ও অ্যালার্জিজনিত খাবার পরিহার
৫। ত্বক শুষ্ক না রেখে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার
৬। চুলকানো পরিহার করে আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার রাখা
ইউনানী চিকিৎসায় চুলকানির প্রাকৃতিক সমাধান:
ইউনানী চিকিৎসা প্রাচীন ভিত্তিক একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসাব্যবস্থা, যার মূল দর্শন হলো দেহের স্বাভাবিক সাম্যাবস্থা বজায় রাখা এবং রোগের উৎস দূর করা। চুলকানির ক্ষেত্রে ইউনানী চিকিৎসা যে উপায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হলো—
১. রক্ত পরিশোধন :
চুলকানির অন্যতম মূল কারণ হলো রক্তের দূষণ। ইউনানী ঔষধ যেমন এত্রিফলে শাহ্তারা, শরবতে ওন্নাব এবং হাব্বে মুছাফ্ফী ব্যবহারে রক্ত বিশুদ্ধ হয়।
২. ভেষজ তৈল ও মলম:
রোওগন নিম, রোগন চন্দন ইত্যাদি প্রাকৃতিক তৈল ত্বকে প্রয়োগ করলে শীতলতা আসে এবং চুলকানি প্রশমিত হয়।
৩. ভেষজ স্নান :
নিমপাতা, মেথি, হরিতকী ইত্যাদির ক্বাথ দিয়ে স্নান করলে ত্বক জীবাণুমুক্ত হয় এবং আরাম মেলে।
৪. আহার ও জীবনাচার:
উষ্ণ ও ঝালজাতীয় খাদ্য পরিহার এবং শসা, জাম, তেতুল ইত্যাদি ঠাণ্ডা প্রভাবযুক্ত খাবার গ্রহণ চুলকানি প্রতিরোধে সহায়ক।
৫. দেহের মেজাজ ভারসাম্য:
ইউনানী মতে, দেহের ‘মিজাজ’ (স্বভাব) অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচন করা হলে দ্রুত উপকার মেলে।
চুলকানির জন্য ইউনানী ব্যবস্থাপত্র:
রোগ: চুলকানি (Pruritus) :
ধরণ: সাধারণ বা রক্তদূষণজনিত চুলকানি
ভেতরে ব্যবহারের ঔষধ:
১। মা”জুন মুছাফ্ফী
মাত্রা: ৫ গ্রাম (১ চা চামচ), দিনে ২ বার
ব্যবহারবিধি: সকালে ও রাতে, খাবারের পরে কুসুম গরম পানির সঙ্গে
২। মা”জুন ওশবা
মাত্রা: ৭ গ্রাম, দিনে ১ বার
ব্যবহারবিধি: রাত্রে শয়নকালে পানিসহ সেব্য।
৩। কুরছ আছ্ফর
মাত্রা: ২ ট্যাবলেট
ব্যবহারবিধি: ১-২ বার সেব্য।
৪। ক্বাথ (ভেষজ ক্বাথ)
উপাদান: নিমপাতা (৫ গ্রাম), হরিতকী (৩ গ্রাম), চিরতা (৩ গ্রাম), গোলমরিচ (২টি)
প্রস্তুত প্রণালী: ১ গ্লাস পানিতে সেদ্ধ করে ১/২ গ্লাসে নামিয়ে ছেঁকে নিতে হবে
ব্যবহার: দিনে ১ বার, সকালে খালি পেটে
বাহ্যিক ব্যবহারের ঔষধ:
১। রোওগন নিম
উপকারিতা: অ্যান্টিসেপটিক, ছত্রাকনাশক
ব্যবহার: দিনে ২ বার আক্রান্ত স্থানে মৃদুভাবে লাগাতে হবে
২। নিমপাতার স্নান
পদ্ধতি: ১০-১২টি নিমপাতা ১ লিটার পানিতে সেদ্ধ করে ঠান্ডা করে গোসল করুন
ব্যবহার: প্রতিদিন একবার
অতিরিক্ত পরামর্শ:
ঝাল ও তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন, টাইট বা সিনথেটিক কাপড় পরিহার করে সুতির ঢিলা পোশাক পরুন, ত্বকে চুলকানো থেকে বিরত থাকুন।