মহাপ্রলয়ের প্রহরে: যদি সমস্ত প্রাণীকুল ধ্বংস হয়; তবে সেই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যস্থপতি মানুষই

মহিউদ্দিন মহিন: মানবসভ্যতা দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় যখন মহাকাশ জয় করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন দরজায় দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতকে পুনর্নির্মাণ করছে—তখন এই একই সভ্যতা নীরবে, অদৃশ্য হাতে পৃথিবীর বুকে বোনা হাজারো প্রাণের জীবনরেখায় কুঠারাঘাত করছে। প্রকৃতি যেন প্রতিদিন একটু একটু করে নিঃশ্বাস হারাচ্ছে; বনের পাতারা নীরবে ঝরে পড়ছে; নদীর জল দগ্ধ হয়ে উঠছে; আর আকাশের পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে অচেনা এক অন্তরালে। যদি সত্যিই মহাপ্রলয়ের আগে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকুল একে একে বিলীন হয়ে যায়— তবে সেই গণবিলুপ্তির সইফাইলের শিরোনামে লেখা থাকবে একটিই নাম—মানুষ।
প্রকৃতির কোমল বুকের ক্ষতচিহ্ন: আমাদের নিজস্ব হাতে খোদাই করা হাজারো বছর ধরে পৃথিবী তার বুকে যে বৈচিত্র্য লালন করেছে— মহিষের গর্জন থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার রাতজাগা সুর, নদীর জলে কিলবিল করতে থাকা মাছ থেকে গভীর বনের হরিণের ছুটে চলা— এসব কিছুই এক অদ্ভুত সুমিতিশীল সহাবস্থানের চমৎকার প্রমাণ ছিল। কিন্তু আজ— বন কাটা হচ্ছে কঙ্কালের মতো দাঁড়ানো মানবশহরের ইট-সিমেন্টের জন্য নদীগুলো দুষিত রক্তের মতো বয়ে বেড়াচ্ছে শিল্পবর্জ্য পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে আকাশের নীল বুক থেকে সমুদ্রের গভীরেও পৌঁছে গেছে মানুষের প্লাস্টিকের বিষদাঁত মনে হয় পৃথিবী তার স্বাভাবিক বর্ণমালা হারিয়ে ফেলেছে, আর মানুষের হাতেই লেখা হচ্ছে প্রকৃতির মৃত্যুকাব্য। অপরাধের মঞ্চে মানুষের উপস্থিতিই সর্বাধিক প্রবল, মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী—এই আত্মম্ভরিতার মুকুট মাথায় দিয়ে আমরা ভুলে গেছি যে আমরা প্রকৃতির অংশ, মালিক নই। প্রতিদিন— গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের অগ্নিশ্বাস সমুদ্রপৃষ্ঠের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বায়ুদূষণের বিষাক্ত জাল
অতিমাত্রায় কীটনাশক শিকার, বনভূমি উজাড়, শিল্পায়নের লোভ সব মিলিয়ে আমরা এমন এক মহাবিপদের দিকে দৌড়াচ্ছি, যা কোনো ধর্মগ্রন্থের ‘মহাপ্রলয়’কে যেন বাস্তব রূপ দিয়ে ফেলতে পারে।
বিজ্ঞানীরা নানা সময়ে বলছেন: যদি প্রাণীকুল ধ্বংস হয়, তবে তা কোনো উল্কাপিণ্ড বা আকাশী আগুনে হবে না—বরং মানুষের হাতে। প্রাণীদের মৃত্যু মানেই পৃথিবীর শ্বাস থেমে যাওয়া প্রতিটি প্রাণী— হোক সে পিঁপড়া কিংবা বাঘ, মৌমাছি কিংবা মাছ— পৃথিবীর একেকটি অদৃশ্য স্তম্ভ। মৌমাছি না থাকলে—ফসলহানি। মাছ না থাকলে—জলজ বাস্তুতন্ত্র ধস। পাখি না থাকলে—বীজ ছড়ানো বন্ধ। বাঘ না থাকলে—বনের শৃঙ্খল ভেঙে পড়া। কেঁচো না থাকলে—মাটি মৃত। প্রাণীকুলের বিলুপ্তি মানেই পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংসের কিনারে দাঁড় করানো। আর মানুষ? সে একা দাঁড়িয়ে থাকবে নিজের তৈরি এক নরকরাজ্যে যেখানে— গাছ নেই, প্রাণ নেই, বাতাস নেই, গান নেই। শুধু বেঁচে থাকার নিষ্ফলা যন্ত্রণা। মহাপ্রলয়ের চিত্রনাট্য মানুষের হাতে লেখা, যদি প্রকৃতিই একদিন সিদ্ধান্ত নেয় তার সভ্যতা এই বৃক্ষ, নদী, পাহাড়, পাখি, পশুর সমন্বয়ে গড়া মহাবিশ্ব সংরক্ষণে ব্যর্থ সেই প্রাণীকে শিক্ষা দিতে- তবে মহাপ্রলয়ের আগেই প্রাণীকুলের লোপ পাওয়া এক ধরনের আলামত হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ যেন দুনিয়ার গায়ে লেখা এক সতর্কসংবাদঃ “তোমরা যদি আমাকে হত্যা করো, আমি তোমাদের বাঁচিয়ে রাখব কেন?” মানুষ তার লোভ, ভোগ, আধিপত্য আর সীমাহীন উন্নয়নের নেশায় নিজের চারপাশের সবকিছুকে শুষে নিচ্ছে। যেমন মৃত নদী আর নীরব বনপ্রান্ত বলছে— প্রকৃতি ক্লান্ত, বিদীর্ণ, আহত। তবুও আশার আলো আছে—যদি মানুষ জাগে হ্যাঁ, মানুষই ধ্বংসের কারণ— তবুও মানুষই পারে বাঁচাতে। বনকে রক্ষা করা নদীর স্বর ফিরিয়ে আনা প্রাণীদের আবাসস্থল অক্ষত রাখা, শিকার কমানো, বিষমুক্ত কৃষি দূষণ নিয়ন্ত্রণ, টেকসই উন্নয়ন এই কয়েকটি পদক্ষেপই আমাদের ভবিষ্যতের বিপর্যয় ঠেকাতে পারে।
আমরা ভুললে চলবে না— প্রকৃতির মৃত্যু মানেই মানুষের মৃত্যু। কারণ পৃথিবী মানুষের জন্য নয়— মানুষ পৃথিবীর জন্য। যদি কোনোদিন সব প্রাণীকুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়— তবে তাকে প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, মানুষের আত্মঘাতী যুদ্ধই বলা হবে। মহাপ্রলয় কোনো ধর্মীয় কাহিনির কাল্পনিক চিত্র নয়— বরং মানুষের হাতেই লেখা এক নির্মম সম্ভাবনার ইতিহাস। যে ইতিহাস আমরা আজই বদলে দিতে পারি— যদি চাই।
যদি বুঝি। যদি প্রকৃতিকে আবার ভালোবাসতে শিখি।
