নলছিটির সুবিদপুর ও কামদেবপুরের শীতলপাটি শিল্পে ফিরতে শুরু করছে সুদিন
মশিউর রহমান রাসেল,ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি তৈরির কারিগর পাটিশিল্পিদের সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। অনেকেই পেয়েছেন সরকারি প্রশিক্ষন তাই নতুন করে আবারও কাজে ফিরতে শুরু করেছেন মুখ ফিরিয়ে নেয়া পাটিশিল্পিরা। বর্তমানে শীতলপাটি তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন উপকরণ তৈরি করে নিজেদের আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে এই পেশার সাথে প্রায় এক হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জরিত আছেন। এটা শুধু তাদের পেশা না তারা একটি ঐতিহ্যবাহী পন্যের ধারক ও বাহক হিসেবে আছেন। দেরিতে হলেও সরকারী প্রশিক্ষণ পেয়ে আবারও স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন তারা।
ঝালকাঠির ব্র্যান্ডিং পন্যের তালিকাভুক্ত সারাদেশের মানুষের কাছে পছন্দনীয় ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির একসময় রমরমা অবস্থা থাকলেও উচ্চ শ্রমমূল্য,প্লাস্টিক পন্যের সহজলভ্যতার কারনে বিক্রি কমতে থাকায় বাধ্য হয়ে এই পেশার সাথে জরিত লোকজন অন্য পেশাকে বেছে নিয়েছেন। জেলার নলছিটি উপজেলার মোল্লারহাট ইউনিয়নের কামদেবপুর ও গোপালপুর গ্রামে অবস্থিত পাটিকর পাড়ায় একসময় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ এই পেশায় জরিত ছিল। তাদের হাতে তৈরি পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী শীতলপাটি দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হতো। তবে কালের পরিক্রমায় আধুনিক পন্যের ভিড়ে শীতলপাটির চাহিদা কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে বাপ দাদাদের শতশত বছরের পুরনো পেশা অনেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রবীন পাটিশিল্পি বিবেকানন্দ জানান,আনুমানিক পাঁচশত বছর আগ থেকে আমাদের এখানের লোকজন এই পেশার সাথে জরিত তবে সময়টা এর থেকেও বেশি হতে পারে। বর্তমানে ২শত পরিবার ও তাদের সদস্যরা এই পেশার সাথে জরিত আছেন। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি নারী পাটিশিল্পি রয়েছেন। আগে আরও বেশি ছিল কিন্তু নানান সমস্যার কারনে অনেক পরিবার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শীতলপাটি তৈরি উপাদান পাইত্রা গাছ জমি থেকে কেটে সেটা প্রসেস করেন। তারপর মহিলা সদস্যরা তা দিয়ে শীতলপাটি বুনন করেন।
তিনি আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের বিনা সুদে ঋণ দিত তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো হতো। কারন শীতলপাটি তৈরির যে উপকরন পাইত্রা গাছ সেটা প্রক্রিয়াজাত করার জন্য বড় বড় ড্রামের দরকার হয় এবং কাটার জন্য ধারালো ও ভারী বটি তৈরি করতে হয়। এছাড়া আমাদের জমিতে পাইত্রা গাছ লাগানো থাকে সেখানে তো অন্য কোন কৃষি ফসল লাগাতে পারি না। সেটা পুষিয়ে নিতে বিনাসুদে আমরা ঋণ পেলে আমাদের উপকার হতো এবং পুরনো ঐতিহ্যবাহী পন্য শীতলপাটি সগর্বে টিকে থাকতো।
পাটিশিল্পি মালতী রানি জানান, বংশপরস্পরায় এই পেশার সাথে আমরা জরিত আছি আমার শ্বাশুড়ির বয়স ষাট বছরের উপরে হলেও তিনি এখনো শীতলপাটি বুনন করতে পারেন। কিন্তু এখন আমাদের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। কারন শীতলপাটির সেই আগের মতো চাহিদা নেই। তবে এখন আমাদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাই আমরা শীতলপাটি তৈরির পাশাপাশি টিস্যু বক্স,কলমদানি,লেডিস ব্যাগ তৈরি করি। এর মাধ্যমে আমাদের বাড়তি আয় হচ্ছে। এছাড়া প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শীতলপাটি তৈরি নতুন কিছু ডিজাইন শেখানো হয়েছে যেগুলো তৈরি করতে পারলে আমাদের পাটির চাহিদা বাড়বে। তাই এখন আমরা আর্থিক সচ্ছল হওয়ার চেষ্টা করছি। সবমিলিয়ে যদি বিক্রি ভালো হয় তাহলে আমাদের আবারও সুদিন ফিরবে।
ব্যবসায়ী সন্দিপ চন্দ্র বলেন, আমি এখানের পাটিশিল্পিদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের শীতলপাটি সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করি। যার মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন বড় বড় শপিং মলও রয়েছে। তারা সেগুলো দেশের বাহিরেও বিক্রি করে থাকেন। প্রতিমাসে এখানে গড়ে প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকার শীতলপাটি তৈরি হয়। এখন তারা শীতলপাটি তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য কিছু উপকরন তৈরি করছেন সেগুলোর বেশ চাহিদা আছে এবং বিক্রিও ভালো হচ্ছে। সরকার আরও একটু সুনজর দিলে শীতলপাটি তার হারানো গৌরব সম্পুর্নরুপে ফিরে পাবে এবং পাটিশিল্পিরাও তাদের পেশাকে আরও ভালোভাবে আকড়ে ধরবেন। প্রচারের মাধ্যমে যদি বিদেশে বিক্রি বাড়ানো যায় তাহলে বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে শীতলপাটির ভালো ভুমিকা থাকবে।
নলছিটি উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তা(ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম জানান, সরকার সকল ঐতিহ্যবাহী পন্যের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় নলছিটি উপজেলার ৬০জন পাটিশিল্পিকে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পাটিশিল্পের মানোন্নয়নে করনীয় শীর্ষক প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে। তাদের যে কোন প্রয়োজনে উপজেলা প্রশাসন পাশে আছে।