১৯৭১ সালের গণহত্যা ও ভোলা জেলা
বিপ্লব মন্ডলঃ একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো, তা ছিল ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। পাক বাহিনীর পরিকল্পিত এ গণহত্যায় প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লাখের অধিক মানুষ, সম্ভ্রম হারিয়েছিল ২ লক্ষাধিক মা-বোন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গভীর রাতে ঘুমন্ত বাঙালী নিধনের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। যার ব্যত্যয় ঘটেনি দীপঞ্চল ভোলাতেও।পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভোলায় আসে মে মাসে। আর তাদের গণহত্যা নির্যাতন শুরু হয় জুন মাসের দিকে।
ওয়াপদা কলোনির গণহত্যাঃ
ভোলার ওয়াপদা কলোনিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে পাক বাহিনীর মূল হত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র। ওয়াপদা ভবন সুরক্ষিত ও তাদের মূল ঘাটি হওয়ায় সমগ্র ভোলা মহকুমা থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে সেখানে বন্ধী করে নির্যাতন ও হত্যা করা হত। লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য তারা ব্যবহার করত খেয়াঘাট ( বর্তমান লঞ্চঘাট)। ফলে ওয়াপদা কলোনি ও খেয়াঘাট হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপুরী। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার বর্ননা দিতে গিয়ে একাত্তরে খেয়াঘাটের চা বিক্রেতা মোঃ আব্দুল্লাহ বলেন,” রাত হলেই পাকিস্তানি আর্মিরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে আনা মানুষগুলোকে হত্যা করার জন্য খেয়াঘাট নিয়ে আসত। গাড়ির শব্দ শুনলেই আমরা দোকান ফেলে পালিয়ে যেতাম। তারা গাড়ি ভর্তি করে মানুষ নিয়ে আসত। এদের মধ্যে নারী-শিশুও ছিল। খেয়াঘাটেই তারা নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যা করত।” এই কেন্দ্রে এমন কোন রাত ছিল না যে, ১০-১৫ জন বাঙালীকে হত্যা করা হত। অধিকাংশই বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হত। এই কলোনির রেস্ট হাউজ ছিল পাশবিকতার কেন্দ্রস্থল। এখানে রাতের পর রাত ক্যাপ্টেন মুনীর হোসেন এবং সুবেদার সিদ্দিক অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করেছে। ক্যাপ্টেন মুনীর লগটপাট করে টাকা ও সোনা-দানা হাতিয়ে নিয়েছে। আর একাজে সহযোগিতা করেছে শান্তি কমিটি।
ঘুইঙ্গার হাট গণহত্যাঃ
১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানি বাহীনি ঘুইঙ্গার হাটে আসে। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতেন।মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করার ফলে অনেক মানুষের জীবন বেঁচে যায়। তবু্ও পাক বাহিনী সাতজন মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
খাসের হাট গণহত্যাঃ
ভোলার দৌলতখান উপজেলার উত্তর জয়নগর ইউনিয়নের খাসের হাটে গনহত্যা চলে ১০ অক্টোবর ১৯৭১। এখানে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন।
বোরহানউদ্দিন বাজার খালপাড় গণহত্যাঃ
১৯৭১ সালের ২৯ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বোরহানউদ্দিন বাজারে আক্রমণ চালিয়ে বাজারে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের অতর্কিত হামলায় মানুষ নানা দিক ছুটাছুটি করতে থাকে। গুলিতে অসংখ্য মানুষ আহত ও নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীর হিসাবে ১৩ জন মানুষের নাম পাওয়া যায়।
চরফ্যাশন গণহত্যাঃ
স্বর্ন ব্যবসায়ী রাধা গোবিন্দ দেবনাথ, বিনোদ বিহারী মজুমদারকে রাজারকাররা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নীলকমল গণহত্যাঃ
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের অবস্থান ছিল বেশ শক্তি শালী।চরফ্যাশন উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের যে পরিবার গুলো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়।
(তথ্য সূত্রঃ ‘ একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর’: সুকুমার বিশ্বাস, ‘ যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ ‘: ডা. এম এ হাসান,’ ভোলা জেলার ১৯৭১: গনহত্যা, রেহানা পারভীন।)