ঝালকাঠি জেলার ঐতিহ্যবাহী লবণ শিল্প জৌলুস হারাচ্ছে
![](https://www.bholarkhobor.com/wp-content/plugins/print-bangla-news/assest/img/print-news.png)
এম এ অন্তর হাওলাদারঃ সনাতন পদ্ধতিতে যাত্রা শুরু হলেও এক সময় জেলায় ছোটবড় ২০টি লবণ উৎপাদন কারখানা ছিল। তবে গ্যাস সংকটসহ নানান কারণে অনেক গুলো কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ঝালকাঠি জেলায় ৯টি কারখানা চালু রয়েছে। যার মধ্যে ৩টি সেট্রিফিউজ (সেমি ভ্যাকুয়াম) পদ্ধতির এবং বাকি গুলো সনাতন পদ্ধতির, যেখান থেকে প্রতি মাসে ৩ হাজার ৫০০ টন ভোজ্য লবণ ও ৭ হাজার টন ইন্ডাস্ট্রি লবণ উৎপাদিত হয়। যা ঝালকাঠি জেলার চাহিদা মিটিয়ে আশেপাশের কয়েকটি জেলায় রপ্তানি করা হয়। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঝালকাঠির উৎপাদিত লবণ বিক্রি শুরু হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে এর প্রাথমিক সূচনা হলেও স্বাধীনতার পর জেলায় এই শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটতে থাকে। জেলা সদরের পশ্চিম প্রান্তে বাসন্ডা নদীর তীর ঘেঁষে এই শিল্প গড়ে উঠেছে। মূলত নদীর তীরবর্তী এলাকা হওয়ায় জাহাজ কেন্দ্রীক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ঝালকাঠিতে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটতে থাকে। কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত লবণ পরিবহনের জন্য নৌ পথকেই প্রধান্য দেওয়া হয়ে থাকে।সস্তা ও নিরাপদ হওয়ার কারণে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা তাদের ক্রয়কৃত লবণ নৌপথেই পরিবহন করে থাকেন।
ধীরে ধীরে নানা কারণে সেই জৌলস হারিয়ে যাচেছ। ইতোমধ্যে ১১টি কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মূলত দেশের অন্যান্য জায়গায় গ্যাস সুবিধা নিয়ে আধুনিক ভ্যাকুয়াম পদ্ধতির কারখানা স্থাপন করার কারণে ঝালকাঠিতে এই শিল্প কিছুটা পিছিয়ে পরে। যাঁতাকল পদ্ধতি নিয়ে বাজারে টিকতে না পেরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।তবে বর্তমানে বেশ কয়েকটি আধুনিক সুবিধা সম্বলিত কারখানা রয়েছে।তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ভিন্ন উপায়ে গ্যাস ছাড়া যাঁতাকল পদ্ধতির কারাখানাকে আধুনিক পদ্ধতির কারাখানায় রুপান্তর করেন।তবে গ্যাস ছাড়া ভ্যাকুয়াম পদ্ধতির কারখানা স্থাপন করা সম্ভব না।তাই গ্যাস সমস্যার সমাধান এবং শতভাগ আধুনিক সুবিধা সম্বলিত কারখানা স্থাপন করা গেলে অন্য জেলার মিল গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে বলে জানান শরিফ সল্টের মালিক জামাল শরীফ।
লবণ মিল মালিক সালাউদ্দিন আহমেদ মালেক বলেন,নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে আমাদের ঝালকাঠির লবণ শিল্প কোনো রকম টিকে আছে।করোনার সময় মিল মালিকরা অনেক টাকা গচ্চা দিয়েছেন।সেই সময়ে উৎপাদন থেকে শুরু করে সব জায়গায়ই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি।আমাদের জন্য যদি কম সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ঝালকাঠির লবণ শিল্প আরও প্রসারিত হবে।সেই সঙ্গে কারখানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্যাস সংযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।ঢাকায় একটি মিলে যখন ইউনিট প্রতি উৎপাদন খরচ হয় ৫০০ টাকা সেখানে আমাদের এখানে খরচ হয় ৯০০ টাকা। এই যে উৎপাদন খরচের পার্থক্য সেটাই এখানের মিলগুলোর জন্য বিশাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছি না। তিনি আরও বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ভারত, চীন থেকে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে তা খাবার লবণ হিসেবে বিক্রি করছে। এগুলো দামে সস্তা কিন্তু মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের উৎপাদিত লবণের দাম তুলনামূলক একটু বেশি,তবে মানবদেহের জন্য উপকারি।এসব কারণে লবণ মিল মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
শ্রমিক নেতা মোস্তফা হাওলাদার বলেন, ঝালকাঠি লবণ মিল গুলোতে এক সময় প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কাজ করতো। বিভিন্ন কারণে মিলগুলো বন্ধ হওয়ায় সেটা এখন এক হাজারে নেমে এসেছে। মিলগুলো পুনরায় চালু হলে এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হলে আমরা শ্রমিকরাও লাভবান হবো। এখানে আরও শ্রমিক কাজ করতে পারবে। বর্তমানে ৯টি কারখানা চালু রয়েছে যেগুলোর বেশিরভাগই বাসন্ডা নদীর দুই তীরে অবস্থিত। যেখানে ১ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। যার কারণে প্রত্যক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১ হাজার পরিবার। যাদের সংসারের আয়ের উৎস এই কারখানার শ্রমিকরা। সেই হিসেবে জেলার অর্থনীতিতে তাদের বিশেষ একটা ভূমিকা রয়েছে।
এখানে শ্রমিকের একটা অংশ নারী শ্রমিক, যাদের কাজ মূলত প্যাকেজিং করা। এরমকই একজন শ্রমিক সুফিয়া বেগম বলেন, আমি এখানে প্রায় ১৮ বছর ধরে কাজ করছি। আমার পরিবারের ভরণপোষণ আমার উপরই নির্ভরশীল। তাই এখানের আয় দিয়েই আমার পরিবার কোনো রকম টিকে আছে। সবকিছুর দাম বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কিন্তু মিল মালিকদেরও কিছু করার নেই। কারণ অন্যান্য জায়গার মিলগুলোর চেয়ে এখানে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। তাই তাদের মুনাফা করতে বেগ পেতে হচ্ছে। এসব কারণে বিগত বছরে প্রায় অনেকগুলো মিল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
লবণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হুমায়ুন কবির জানান, আমাদের শ্রমিকদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে গ্যাস সংকটের কারণে মিলগুলো পুরোপুরি আধুনিক করা যাচ্ছে না। যার কারণে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। দুই তিনটি যে আছে সেগুলোও পুরোপুরি আধুনিক ভ্যাকুয়াম পদ্ধাতির না। এছাড়া পারিবারিক কারণেও দু’একটি কারখানা বন্ধ রয়েছে।
ঝালকাঠি বিসিকের উপব্যবস্থাপক মো. সাফাউল করিম বলেন,জেলায় লবণ শিল্পের বিকাশে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু এখন পদ্মা সেতু চালু হয়েছে, খুব শিগগিরই আমরা জেলায় গ্যাস সংযোগ পাবো। তখন মিলগুলো শতভাগ আধুনিক করা হবে। তাহলে আশাকরি অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এছাড়া নতুন উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিয়ে কারখানার সংখ্যাও বাড়ানো হবে।
জেলা প্রশাসক ফারাহ নিঝুম গুল বলেন, ঝালকাঠিতে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। তাদের সমস্যা গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রয়োজনে বিসিকের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করা হবে।