শিক্ষকের মর্যাদা আজ হুমকির মুখে – মনির !!
শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর অথচ বর্তমান সময়ে বেশকিছু ঘটনা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, যেখানে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে খ্যাত শিক্ষক সমাজের কিছু প্রতিনিধি নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। কেউ কেউ ঘটনাপরম্পরায় জেল-জুলুমের মুখোমুখি হয়েছেন। কোথাও বা কাউকে এমনকি চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনা নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা-প্রতিবাদ হয়েছে।বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এসব ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন এবং করছেন। তবে কার্যকারণ যাই হোক, আখেরে মোদ্দা কথা এটাই দাঁড়ায়, সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও পূজনীয় বলে বিবেচিত আমাদের শিক্ষকসমাজের কিছু সদস্য শারীরিক-মানসিকভাবে নাজেহাল হয়েছেন। আমরা হরহামেশা জপ করে আসছি-শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এ পৃথিবীতে শিক্ষাদীক্ষায় উন্নতি ব্যতিরেকে কোনো জাতি উন্নতি করেছে এমনটি কেউ কখনো শোনেনি। এ কারণে অনাদিকাল থেকে প্রত্যেক সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষ কদর পেয়ে আসছেন। প্রাচ্য সমাজে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা যে কতটা উঁচু তার একটি উপমা পাওয়া যায় মোগল বাদশাহ আলমগীরের স্মৃতিধন্য কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতায়, যেখানে আমরা দেখি মহাপ্রতাপশালী দিল্লিশ্বরকে তার সন্তান ওস্তাদের চরণ নিজ হাতে ধৌত না করে কেবল পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন দেখে শিক্ষক মহোদয়কে ডেকে সন্তানের ভব্যতার প্রশ্নে হতাশা প্রকাশ করতে। আজও সমাজের বৃহৎ পরিসরে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষার্থীদের কাছেই নন, তাদের অভিভাবকদের কাছেও বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকেন। এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কেবল জ্ঞানের আদান-প্রদানই হয় না, একধরনের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমন একটি সমাজে আপনি যদি দেখেন, একজন শিক্ষক শারীরিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন, তাহলে চিন্তায় আপনার কপালে ভাঁজ পড়বে-এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
তাহলে কি এমন হলো যে, আমাদের মতো এমন একটি শিক্ষক অন্তপ্রাণ সমাজে এভাবে হুটহাট শিক্ষক নিগ্রহের হিড়িক পড়ে গেল? যে বিষয়টি এখানে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে তা হলো, এ ধরনের ঘটনা কি আগেও ঘটেছে, নাকি ইদানীং হঠাৎ করে ঘটতে শুরু করেছে।
বিষয়টি কি এমন যে, এসব আগে থেকেই চলে আসছে, ইদানীং এ ধরনের ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র? এমন নয়তো যে, শিক্ষকরা ঠিক এরূপ শারীরিকভাবে নিগৃহীত হননি ঠিকই, তবে বহুকাল ধরেই তাদের একশ্রেণির ছাত্রনামধারী সাঙাতকূলের মন জুগিয়ে, মান বাঁচিয়ে চলে আসতে হচ্ছে? বিষয়টি এমন নয়তো যে, সাধারণ শিক্ষকরা তো বটেই, এমনকি প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষের আসন অলংকৃতকারী আপাতদৃষ্টিতে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও রীতিমতো করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করতে বাধ্য হন? চালাকচতুর আর বিচক্ষণ ব্যক্তিদের ব্যাপারস্যাপার অবশ্য আলাদা। তারা এ ধরনের সাঙাতদের সঙ্গে তেলে-তালে, ঝোলে-ঝালে মিলেমিশে এমনভাবে সবকিছু চালিয়ে নিতে পারেন, যাতে আপাতদৃষ্টিতে এমনটিই প্রতীয়মান হতে পারে যে, ‘ইধার কুছ মুশকিল নেহি’। অনেকের চোখে এ ধরনের পারফরম্যান্স দক্ষ ব্যবস্থাপনার পরাকাষ্ঠা বিবেচিত হলেও এভাবে ইজ্জত-সম্মানের প্রশ্নে পদে পদে আপস করে কিল খেয়ে কিল চুরি করার পেছনে যে গভীর বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা দিনের পর দিন বয়ে চলা কত কষ্টকর, তা ভুক্তভোগীরাই বোঝেন। অন্যদিকে, কেউ কেউ মনে করেন, খোঁজ নিলে এমন অনেক করিতকর্মা গুরুদেবের খোঁজও মিলতে পারে, যারা তাদের নানা রকমের অনিয়ম ঢাকতে এবং অন্যায্য অভিসন্ধি পূরণ করতে এ ধরনের সাঙাতদের অতি আদরে লালন করেন। এরা তখন একে অপরের দোসররূপে মনিকাঞ্চন জোড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কখনো বা নানামুখী স্থানীয়-অস্থানীয় চাপের মুখে নিজেদের প্রটেকশনের জন্যও স্কুল-কলেজের শিক্ষাগুরুরা স্ট্র্যাটেজিক কারণে এসব সাঙাতকে পালনে বাধ্য হন বলে অনেকের ধারণা।
আবার কখনো এমনও দেখতে পারেন, ওই দুষ্টু ছোকরাগুলো স্রেফ ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে, আসল ঝামেলাটা গুরুদেবদের নিজেদের মধ্যেই, যারা একে অপরকে দেখে নেওয়ার জন্য ওই ছোকরাগুলোর মাথায় তেল দিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া এমন পর্যবেক্ষণও আছে যে, প্রায়ই এলাকার বিগ ব্রাদাররাও তাদের কায়েমি স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব ছোকরার একটি গ্রুপকে লালন করে থাকেন। তবে যে বিষয়টি জরুরি তা হলো, এ ধরনের যে কোনো ঘটনাকে সিরিয়াসলি নিয়ে এর অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
ওপরের আলোচনার আলোকে এমনটি ভাবা অস্বাভাবিক হবে না যে, অনেক জায়গায়ই দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের জন্য একটি অস্বস্তিকর গুমোট পরিবেশ চলে আসছে। তথাপি বলা চলে, বর্তমানে যে অবস্থা চালু রয়েছে, তাতে শিক্ষকরা কোনোমতে মান বাঁচিয়ে চলছিলেন।
এখন তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো যে, দুর্বৃত্তরা তাদের ওপর গায়ে-গতরে হামলে পড়তে শুরু করেছে? এটা কি আগে থেকে চলে আসা অবক্ষয়ের নতুন পর্যায়, নাকি এর সঙ্গে নতুন কোনো উপাদানের সংযুক্তির ফসল? এটি বুঝতে না পারলে এরকম ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকবে। সরলরৈখিকভাবে সবকিছুকে এক কাতারে না ফেলে প্রতিটি ঘটনার পক্ষপাতহীন চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বোঝা দরকার, সমস্যা একমুখী, দ্বিমুখী না বহুমুখী। নিগৃহীত শিক্ষকরা কি নিতান্তই নিগ্রহের শিকার, নাকি তাদের কারও কারও মধ্যে এমন কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন এসেছে, যা কোনো কোনো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক যোগসূত্রের অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন-সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় আক্রান্ত শিক্ষকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা সাম্প্রদায়িক কারণে হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে। অন্যদিকে তারা তাদের কিছু কার্যক্রমের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন বলেও পালটা অভিযোগ এসেছে।
সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলের একটি কলেজের অধ্যক্ষ স্থানীয় সংসদ সদস্যের হাতে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য হলে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। অপরদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একজন শিক্ষককে হেনস্তা করার জন্য কোনো একটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ইস্যু সামনে আনা হলেও ওটা আসল কারণ নয়, বাহানা মাত্র। স্বার্থান্বেষী মহল ভিন্ন কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর রুষ্ট ছিল এবং তাকে শায়েস্তা করার একটি উপায় খুঁজে ফিরছিল। আবার এমনও দেখা গেছে, সংঘটিত ঘটনা আসলে কোনো ব্যক্তিগত রেষারেষির ফল; কিন্তু তাতে রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।ঘটনা যাই হোক, জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোয় শান্ত, সৌম্য ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষকদের ঐতিহ্যগত সম্মান ও মর্যাদা কেন আজ হুমকির মুখে তা নির্মোহ বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে এবং তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সংঘটিত ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্বিশেষে কার দায় কতটুকু তা নিশ্চিত করতে হবে। হীন রাজনৈতিক কিংবা সাম্প্রদায়িক স্বার্থে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার, অন্য কথায়, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করলে প্রকৃত সমস্যা ও এর আসল কার্যকারণ অচিহ্নিত থেকে যাবে। এমনটি হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার, কোনো সমস্যা প্রাথমিক অবস্থায় সমাধানের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া না হলে তা পরবর্তী সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
আসুন!! শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াই,শিক্ষকের সম্মান বৃদ্ধিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসি।।
#মনির আহাম্মেদ