আফিফ-মিরাজে চট্টগ্রামে ঘুরে দাঁড়ানোর মহাকাব্য লিখল বাংলাদেশ
১ম ওয়ানডে, চট্টগ্রাম (টস-আফগানিস্তান/ব্যাটিং)
আফগানিস্তান- ২১৫, ৪৯.১ ওভার (নাজিবুল্লাহ ৬৭, রহমত ৩৪, হাশমতউল্লাহ ২৮, মোস্তাফিজ ৩/৩৫, শরীফুল ২/৩৮, সাকিব ২/৫০)
বাংলাদেশ- ২১৯/৬, ৪৮.৫ ওভার (আফিফ ৯৩*, মিরাজ ৮১*, ফারুকি ৫৪/৪, রশিদ ৩০/১)
ফলাফল: বাংলাদেশ ৪ উইকেট জয়ী
দুর্দান্ত, দুরন্ত, অনবদ্য, অসাধারণ, অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য! এমন অনেক বিশেষণ অনায়াসে জুড়ে দেয়া যায় আফিফ-মিরাজের ম্যাচ জেতানো, রেকর্ডগড়া এই জুটিকে। যে পরিস্থিতিতে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন এই দুজন, সেখান থেকে দুনিয়ার সবচেয়ে আশাবাদী মানুষটাও হয়তো জয়ের চিন্তা করতে দ্বিতীয়বার ভাববেন। আফিফ-মিরাজ যে রীতিমতো অসাধ্য সাধন করেছেন। দুজনের দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ৪ উইকেটে আফগানিস্তানকে হারিয়ে সিরিজে শুভসূচনা করেছে বাংলাদেশ।
ফজল হক ফারুকির তোপে ১৮ রানের মধ্যেই তামিম ইকবাল-লিটন দাসের পর ফিরে যান মুশফিকুর রহিম আর ইয়াসির আলী। তখন কেউই বোধহয় ভাবেনি ম্যাচটা বাংলাদেশ জিততে পারে। ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে অধিনায়ক তামিমও বলেছেন একই কথা। পরাজয়ের ভাবনা আরো মজবুত হয় সাকিব-মাহমুদউল্লাহর বিদায়ের পর। এমনকি চোখ রাঙাচ্ছিল সবচেয়ে কম রানে গুটিয়ে যাওয়ার পূর্বের রেকর্ডও।
তবে সব শঙ্কা দূর করে, জয়ের ক্ষীণতর সম্ভাবনাকে ধীরে ধীরে বাস্তবে রূপ দিলেন আফিফ আর মিরাজ মিলে। ইনিংসজুড়ে দুজনই ছিলেন হিসেবী আর সাবধানী। সুযোগ বুঝে আগ্রাসী হয়েছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন, তবে নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রন রেখে। দারুণ সামলেছেন আফগানদের স্পিনত্রয়ী রশিদ-নবী-মুজিবকে। রানরেটও রেখেছেন সচল। দুজন মিলে ২২৫ বল খেলে গড়েছেন ১৭৪* রানের জুটি, যা সপ্তম উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। ৩ রানের জন্য ছুঁতে পারেননি জস বাটলার-আদিল রশিদকে। মিরাজ খেলেছেন ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। আর আফিফ তো নিজের প্রথম ফিফটিকে স্মরণীয় করেই রাখলেন। এমন অবিশ্বাস্য জয়ের নেপথ্যে নিজের প্রথম ফিফটি, ছবিগুলো আফিফ চাইলে বাঁধিয়ে রাখতেই পারেন।
৪৫ রানে ছয় উইকেট পড়ার পর প্রথম বাউন্ডারিটা এসেছিল আফিফের ব্যাট থেকে। ম্যাচ জেতানো শেষ বাউন্ডারিটাও মেরেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটারই। ইনিংসজুড়ে দুজন মিলে গিয়ার শিফট করেছেন পরিস্থিতি বুঝে। দুজনের বোঝাপড়াও ছিল দারুণ। কখনো দায়িত্ব নিয়েছেন আফিফ, কখনো মিরাজ। দুজনের ব্যাটিং, চাপ সামলানোর দক্ষতা ও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার সামর্থ্যের দারুণ সমন্বয়ে বাংলাদেশ পেল দুর্দান্ত এক জয়।
এর আগে ২১৬ রানের লক্ষ্যে ইনিংসের প্রথম ওভারের শেষ দুই বলে ফারুকিকে টানা দুই চার মেরে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন অধিনায়ক তামিম। কিন্তু এর এক ওভার তার সঙ্গে লিটনের উইকেটটাও পকেটে পুরেন ফারুকি। ভেতরে ঢোকা দারুণ এক ডেলিভারি লিটনের ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়ে উইকেটরক্ষকের হাতে। এক বল পর লাইন মিস করে এলবিডব্লিউ হন তামিম। রিভিউ নিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তার।
মুশফিকও ফিরেছেন একই ঢংয়ে। বলের লাইন মিস করে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়েছেন এই ডানহাতি ব্যাটার। ইয়াসিরকে তো রানের খাতাই খুলতে দেননি ফারুকি। সেই ওভারের শেষ বলে তাকে ফ্লিক করতে যান ইয়াসির। লেন্থ বলটা ঠিকঠাক বুঝতে না পারায় অভিষেকেই শূন্য রানে বোল্ড হন ডানহাতি এই ব্যাটার। বিপদ আরো বাড়ে সাকিবের বিদায়ে। মুজিবের করা অফ স্টাম্পের বাইরের বল ড্রাইভ করতে গিয়ে ইনসাইড এজে বোল্ড হয়েছেন তিনি। লেগ স্পিনার রশিদের শর্ট লেন্থের বলে স্লিপে ক্যাচ দেন মাহমুদউল্লাহ।
প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের বোলারদের নিয়ন্ত্রিত স্পেলে ২১৫ রানে গুটিয়ে যায় আফগানিস্তান। আফগানদের দশ উইকেটে সাতটিই নিয়েছেন পেসাররা মিলে। বাকি তিনটি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেছেন সাকিব-রিয়াদ।
দ্বিতীয় ওভারেই মোস্তাফিজকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হন রহমানউল্লাহ। এর আগে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান তিনি। এরপর রহমত শাহকে নিয়ে ৪৫ রানের জুটি গড়েন ইব্রাহিম জাদরান। সেই জুটি ভাঙতে পারতো আরো আগেই, ষষ্ঠ ওভারে মাহমুদউল্লাহ ইব্রাহিমের ক্যাচ না ছাড়লে। ইব্রাহিমকে ফিরিয়েছেন শরীফুল।
থিতু হয়ে রহমত শাহ ফিরেছেন তাসকিনের আচমকা লাফিয়ে ওঠা বলে। মুশফিকের হাতে ব্যক্তিগত ৩৪ রানে ক্যাচ দেন আফগানদের এই ব্যাটিং ভরসা। হাশমতুলউল্লাহও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অধিনায়ক তামিমের বোলিং চেঞ্জের টোটকায় আউট হয়েছেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান।
এরপর মিডল অর্ডারে নবি-নাজিবউল্লাহর দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ঘুরে দাঁড়ায় আফগানিস্তান। বাংলাদেশের বোলারদের কোনো সুযোগ না দিয়ে দুজন গড়েন ৬৩ রানের জুটি। নবি ২২ রানে ফিরলেও ফিফটি তুলে নেন নাজিবউল্লাহ। নবির বিদায়ের পর নাজিবউল্লাহর সাথে ছোট একটা জুটি অবশ্য হয়েছিল গুলবাদিন নাইবের। অবশ্য সেটার স্থায়ীত্ব ছিল ২৯ রান। সেই জুটি ভেঙে সাকিব হানেন জোড়া আঘাত। ৪৫তম ওভারে নাইবের পর সাকিব পেয়েছেন রশিদের উইকেটও।
এর আগে নাজিবউল্লাহর দৃঢ় ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল, ২৫০ ছোঁয়া সংগ্রহ হয়তো পেয়ে যাবে আফগানিস্তান। তবে শেষদিকে বাংলাদেশের পেসাররা জ্বলে উঠায় আফগানিস্তানের সংগ্রহ ২১৫ এর বেশি পেরোয়নি। উইকেট আঁকড়ে থাকা নাজিবউল্লাহর সাথে মোস্তাফিজ-শরীফুলরা বিদায় করেছেন আফগানিস্তানের টেল এন্ডারদের।