আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে চান? - বিস্তারিত
  • রবিবার, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ইং, ১৫ই জমাদিউস-সানি, ১৪৪৭ হিজরী
সর্বশেষঃ

আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীর— মোঃ মহিউদ্দিন

ভোলা জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উন্নয়নের ধারায় এক উজ্জ্বল নাম— আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীর। শিক্ষানুরাগ, সমাজসেবা, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অনন্য জীবনপথ।
১৯৪৬ সালে ভোলা শহরের উপকণ্ঠের শান্ত নির্জন গ্রাম জামিরালতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ তাঁর জীবনের প্রথম থেকেই পরিলক্ষিত হয়। বরিশালের ঐতিহ্যবাহী বিএম স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং বিএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ও আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি (এল.এল.বি) অর্জন করেন — যা তাঁকে একাধারে বিদ্বান ও চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। রাজনীতিকে তিনি দেখেছেন দেশ ও সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে। তবে রাজনীতির পাশাপাশি তিনি পৈতৃক ব্যবসা পরিচালনায়ও যুক্ত ছিলেন — একাধারে সমাজচিন্তক, ব্যবসায়ী, শিক্ষানুরাগী ও সেবক হয়ে ওঠেন সময়ের প্রেক্ষাপটে। তাঁর পিতা মরহুম আলতাজের রহমান তালুকদার (বড় মিয়া) ছিলেন ভোলার জমিদারী ঐতিহ্যের এক কিংবদন্তি পুরুষ — যার আভিজাত্য শুধু অর্থে নয়, মানবিকতা ও জনকল্যাণে। তিনি শিক্ষা, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ভোলার সমাজজীবনে নবজাগরণ এনেছিলেন। তাঁর হাতেই ভোলায় প্রথম বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা নামাঙ্কিত হয়েছিল তাঁর সহধর্মিণী মাছুমা খানম চৌধুরাণীর নামে। এই পরিবারই পরবর্তীতে ভোলায় একাধিক কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, যা আজও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আলহাজ্ব আলমগীরের বড় ভাই মোশারেফ হোসেন শাজাহান ছিলেন এক বরেণ্য রাজনীতিক — বিএনপি’র উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রের বিশিষ্ট ক্বারী, আলেম ও শিক্ষাবিদ মাওলানা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীনের কন্যা আফিফা মুস্তারীর সঙ্গে। আফিফা মুস্তারী ছিলেন লালমাটিয়া কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা—শিক্ষা, শুদ্ধতা ও প্রজ্ঞার প্রতীক। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীর নিজেকে জড়িয়েছেন শিক্ষা, সমাজসেবা ও মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে। তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জাতীয় বন্ধুজন পরিষদসহ বহু শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা ও সেবামূলক মানসিকতার স্বীকৃতি ছড়িয়ে আছে দেশে ও বিদেশে। mতিনি সৌদি আরব, পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, মালি ও ইংল্যান্ডসহ নানা দেশে সফর করেছেন—নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে। ১৯৮৪ সাল থেকে বিপুল ভোটে পরপর তিনবার ভোলা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। এই দীর্ঘ পৌর প্রশাসনিক জীবনে তিনি নিজেকে নিবেদিত করেন সাধারণ মানুষের সেবায়। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির যৌথ স্বার্থে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের কারণে তাঁকে অন্যায়ভাবে কারাবরণ করতে হয়—কিন্তু তাঁর জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। তাঁর ভাষায়, “রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতা নয়; রাজনীতি মানে সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন। কল্যাণমুখী রাজনীতির স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন।” ভোলার উন্নয়ন প্রসঙ্গে আলহাজ্ব আলমগীর উল্লেখ করেন — পূর্বতন আমলে শুরু হওয়া ভোলা–বরিশাল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে তাঁর পরিবারের ভূমিকাই ছিল অগ্রণী। তৎকালীন জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী মোশারেফ হোসেন শাজাহান ভেদুরিয়াতে হেরিংবন্ড রাস্তার কাজের উদ্বোধন করেন। পরে এরশাদ আমলে নাজিউর রহমান মঞ্জুর সড়কের আরও উন্নয়ন সাধন করেন। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে এ সড়কটি বরিশাল–ভোলা–লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক হিসেবে জাতীয় গুরুত্ব লাভ করে। তখনকার প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাজাহান ‘৯৫ সালে খেয়াঘাট নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, যার কাজ আওয়ামী লীগ আমলে সম্পন্ন হয়ে উদ্বোধন হয় — যা ভোলার ইতিহাসে এক মাইলফলক।
বোরহানউদ্দিন–শাহবাজপুর গ্যাস উত্তোলন প্রসঙ্গে আলহাজ্ব আলমগীর বলেন — বেগম জিয়ার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘৯৫ সালে ড্রিলিং কাজ সম্পন্ন হয়। তিনি জোর দাবি জানান, যাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করে ভোলায় সার কারখানা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তাঁর মতে, > “বেগম জিয়ার আমলে ভোলাকে মেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম প্রয়াস।” তিনি দুঃখ করে বলেন, পরবর্তী সরকারের আমলে জাতীয় অর্থনীতির মন্দার সাথে সাথে ভোলার উন্নয়নও মুখ থুবড়ে পড়ে। পৌরসভার উন্নয়ন প্রসঙ্গে আলহাজ্ব আলমগীর বলেন, “আমার আমলে পৌর এলাকার প্রয়োজনীয় ব্রিজ, কালভার্ট, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামোগত কাজ সম্পন্ন করেছি। এখন প্রয়োজন শুধু রক্ষণাবেক্ষণ। শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বিবেচনা করে আমি কখনো ট্যাক্স বাড়াইনি। সরকারি বিধি অনুযায়ী ট্যাক্সের চাপ সৃষ্টি হলেও আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে।” নাট্যচর্চা, সঙ্গীত ও সাহিত্যপ্রেম তাঁর ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও স্বার্থবর্জিত জনসেবা আজও মানুষের হৃদয়ে অম্লান।
ভোলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীর — তিনি একদিকে ঐতিহ্যের ধারক, অন্যদিকে আধুনিকতার অগ্রদূত। আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীর— নামটি শুধু এক ব্যক্তির নয়, ভোলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। তাঁর জীবনগাথা প্রমাণ করে, সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে জ্ঞান, মানবিকতা ও ত্যাগের সমন্বয়ে। # লেখক, কবি, সাহিত্যিক সিনিয়র লেকচারার

ফেসবুকে লাইক দিন